আবু সাইদ বিশ্বাস.সাতক্ষীরাঃ ২০১৩ ফেব্রুয়ারী থেকে ২০১৪ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় শুধু সাতক্ষীরা জেলাতে ৪৩ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে যৌথবাহিনীর গুলীতে নিহত হয়েছেন ২৭ জন। এদের সবাই স্থানীয় জামায়াত , ছাত্রশিবির ও বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদলের নেতাকর্মী। এছাড়া আরও ২৫ জন নেতাকর্মী গুলীবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক ব্যক্তি। এসব ঘটনায় দায়িদের বিরুদ্ধে কোটে মামলা হলেও একটি ঘটনারও সুষ্ঠু বিচার পায়নি নিহতের পরিবার। হত্যায় অভিযুক্ত ও ইন্ধনদাতা পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে। ফলে ভুক্তভোগী পরিবারের মাঝে উদ্বেগ বাড়ছে।
হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল আল্লামা দেওলয়ার হোসেন সাঈদীর রায়ের পর
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, মূলত ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর থেকেই সহিংস হয়ে ওঠে সাতক্ষীরা জেলা। এছাড়া প্রধান বিরোধী দল ও জোটকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যৌথবাহিনীর অভিযান শুরু হলে হত্যাকা-ের ঘটনা আরও বেড়ে যায়। নিহতের অধিকাংশই যৌথবাহিনীর গুলীতে মারা যান।
সাঈদীর ফাঁসির রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষে পুলিশের বেপরোয়া গুলীতে জামায়াত-শিবিরের ৭ জন নেতাকর্মী ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। এরা হলেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার রইচপুর গ্রামের আল মফিজুদ্দিনের ছেলে জামায়াত কর্মী সদর উপজেলার মুন্সিপাড়া এলাকার হাজি শাহাবুদ্দীনের ছেলে জামায়াত কর্মী আল আবদুস সালাম (৬০), একই উপজেলার আগরদাড়ি ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের ছেলে জামায়াত কর্মী মাহমুদুল হাসান (২০), ঘোনা ইউনিয়নের গাজীপুর গ্রামের আনারুল ইসলামের ছেলে জামায়াত কর্মী রবিউল ইসলাম (২৫), শিবপুর ইউনিয়নের খানপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে জামায়াত কর্মী সাইফুল ইসলাম (২০), শিবপুর ইউনিয়নের পায়রাডাঙ্গা গ্রামের অজিয়ার রহমানের ছেলে শিবির কর্মী শাহিন আলম (২০) ও আগরদাড়ি ইউনিয়নের হরিশপুর গ্রামের আবদুল বারীর ছেলে শিবির কর্মী ইকবাল হাসান তুহিন (২২)।
২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি তালা উপজেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ও ইসলামকাঠি ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আজহারুল ইসলামকে (২৮) বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে থানায় নেয়ার পর গুলী করে হত্যা করে যৌথবাহিনী। এর আগে ২৬ জানুয়ারি রোববার গ্রেফতারের পর থানায় দুদিন আটক রেখে নির্যাতনের পর নারকেলি গ্রাম নামক স্থানে নিয়ে যৌথবাহিনী গুলী করে হত্যা করে দেবহাটা উপজেলার নতুন বাজারের কুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও দেবহাটা উপজেলা ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি আবুল কালাম (১৭) ও একই গ্রামের জামায়াত কর্মী মারুফ হাসান ছোটনকে (২২)।
একই বছর ১৮ জানুয়ারি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভোমরা ইউনিয়নের পদ্মশখরা গ্রামের শহর আলীর ছেলে শিবির নেতা আবু হানিফ ছোটনকে (১৯) ক্রসফায়ারে হত্যা করে যৌথবাহিনী। একই মাসের ১৩ তারিখে দেবহাটা উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের আবদুল হামিদ গাজীর ছেলে জামায়াত কর্মী আনারুল ইসলামকে (৩০) গুলী করে হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসেই সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা গ্রামের মৃত আবদুল আজিজের ছেলে আবদুল হাকিম (৫০) ও সদর উপজেলার আগরগাড়ি ইউনিয়নের জামায়াত কর্মী কামাল্দ্দুীনকে গুলীতে নিহত হয়। ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর গুলীতে নিহত হন আগরদাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিএনপির জনপ্রিয় নেতা মো. আনোয়ারুল ইসলাম (৪৫)। ২৩ ডিসেম্বর সদর উপজেলার ঝাইডাঙ্গা ইউনিয়নের দবিন্দকাটি গ্রামের লোকমান দফাদারের ছেলে জামায়াত কর্মী হাফিজুল ইসলামকে (২২) যৌথবাহিনী গুলী করে হত্যা করে।
২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর সদর উপজেলার কুশখালী ্ইউনিয়নের সাতানী গ্রামের আবদুল ওয়াহেদের ছেলে জামায়াত কর্মী জাহাঙ্গীর হোসেনকে (২৭) গুলী করে হত্যা করে যৌথবাহিনী। ২০১৩ সালের ৩ ডিসেম্বর দেবহাটা ইউনিয়নের গরানবাড়ী গ্রামের সাবেদ আলীর ছেলে শিবিরকর্মী আরিজুল ইসলামকে (১৬) বুকে গুলী করে হত্যা করা হয়। একই দিন দেবহাটা উপজেলার সখীপুর গ্রামের ফজর আলীর ছেলে শিবিরকর্মী আবুল হোসেনকে (১৫), ২৭ নভেম্বর সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের শিয়ালডাঙ্গা গ্রামের আবদুল মাজেদের ছেলে জামায়াত কর্মী শামসুর রহমানকে (৩৫) যৌথবাহিনী গুলী করে হত্যা করে।
১৬ জুলাই ২০১৩ তারিখে কালীগঞ্জ উপজেলার কুশলিয়া ইউনিয়নের বাজারগ্রামের আফতার উদ্দিনের ছেলে শিবিরকর্মী মোস্তফা আরিফুজ্জামানকে (১৭) গুলি করে হত্যা করে যৌথবাহিনী। একই দিন কালীগঞ্জ উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের রঘুরামপুর গ্রামের নুর ইসলাম গাজীর ছেলে জামায়াত কর্মী রুহুল আমিন (৩৭) যৌথবাহিনীর গুলীতে নিহত হন।
২০১৩ সালের ৫ মার্চ কলারোয়া উপজেলার যুগিখালী ইউনিয়নের ওফাপুর গ্রামের আবদুল মুজিদের ছেলে জামায়াত কর্মী শামসুর রহমানকে (৪৫) গুলী করে হত্যা করা হয়। ৪ মার্চ কলারোয়া উপজেলার যুগিখালী ইউনিয়নের কামারালী গ্রামের মৃত রহিম মোড়লের দুই ছেলে জামায়াত কর্মী আরিফ বিল্লাহ (৩৫) ও রুহুল আমিনকে (৩২) গুলী করে হত্যা করে যৌথবাহিনী।
এছাড়া বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগ ও পুলিশের হামলায় ২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের শিয়ালডাঙ্গা গ্রামের ইলিয়াস হোসেনের ছেলে জামায়াত কর্মী সাইদুল ইসলাম (৩৩), একই বছরের ৫ নভেম্বর তালা উপজেলার সুরুলিয়া ইউনিয়নের সুরুলিয়া গ্রামে জাকের সরদারের ছেলে জামায়াত কর্মী আবদুস সবুর (৩৫) নিহত হন। ১৫ অক্টোবর শ্যামনগর উপজেলার কাশিমারী ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের আফতাব উদ্দীনের ছেলে জামায়াত কর্মী শফিকুল ইসলাম (৪৪) ও আশাশুনি উপজেলার বড়দল ইউনিয়নের জামালনগর গ্রামের মৃত আবদুল জব্বারের ছেলে আতিয়ার রহমান নিহত হন।
এভাবেই গত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলীতে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ২৭ জনসহ রাজনৈতিক সহিংসতায় এ প র্যন্ত ৪৩ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া ২৫ জন গুলীবিদ্ধসহ আহত হয়েছে আরও কয়েক শতাধিক ব্যক্তি। গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে অনেক নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘর। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশেই যৌথবাহিনী এসব ঘটনা ঘটিয়েছে।
নিহতদের পরিবারের দাবি, যৌথবাহিনীর সদস্যরা হত্যাকা-ের একদিন-দুদিন আগে নিজ বাসা অথবা কর্মক্ষেত্র থেকে তাদের গ্রেফতার করে। পরে তাদের থানা হেফাজতেও রাখা হয়। এরপরই বিভিন্ন স্থানে তাদের লাশ পাওয়া যায়। পুলিশের পক্ষ থেকেও গ্রেফতারের বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারির শুরু থেকে গত ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪১ দিনে ৪৪ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পৃথক স্থানে সংঘটিত ওই ৬টি হত্যাকা-ের পর পুলিশের ভাষ্য ছিল প্রায় অভিন্ন। তাদের বক্তব্য, গ্রেফতারকৃতদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মধ্যরাতে তাদের সঙ্গে নিয়ে এলাকার তথাকথিত তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেফতার ও অস্ত্রের ভা-ার উদ্ধার অভিযানে বের হলে মাঝপথে সঙ্ঘবদ্ধ চক্রের সঙ্গে তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যৌথবাহিনীর গুলীতে ঘটনাস্থলেই এসব ব্যক্তি নিহত হন।কিন্তু নিহতের পরিবারগুলো বলছে, গ্রেফতারের পর বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা যৌথবাহিনীর সাজানো নাটক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যৌথবাহিনীর গুলীতে নিহত এসব ব্যক্তিদের কারো বুকে, পিঠে, মাথায়, পেটে, পায়ে, মুখে ও কোমরে গুলীর চিহ্ন রয়েছে। গ্রেফতারের পর থানা হেফাজতে থাকার এক-দুদিন পর রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হত্যাকা-ের শিকার হওয়া ওই ৬ জনই স্থানীয় বিএনপি, ছাত্রদল, জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী। তারা এলাকায় সক্রিয় ও জনপ্রিয় হিসেবেই সবার কাছে পরিচিতি ছিলেন।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বিচারবহির্ভূত হত্যা এসব হত্যা কান্ডের বিচার চেয়ে সাতক্ষীরা কোটে ভুক্তভোগী পরিবার সমূহের পক্ষে মামলা দায়ের করা হলেও পুলিশ এখনো পর্যন্ত কাউকে আটক করেনি। এমনকি বেশির ভাগ মামলা থেকে আসামীদের বাদ দিয়ে পুলিশ ফাইনাল দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পুলিশের দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ক বলেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মামলার তদন্ত হচ্ছে। কোনো আসামি ও বাদী ন্যায়বিচার থেকে যেন বঞ্চিত না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। তবে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো নিয়ে আমরা বেশি বিব্রত। তিনি আরও বলেন, আমরা চেষ্টা করছি সুষ্ঠু তদন্ত করে চার্জশিট দিতে। যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে না, তাদের বিষয়ে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হবে। নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হবে না।