‘নাটোরের কাঁচাগোল্লা’ শুধু একটি মিষ্টির নামই নয়, একটি ইতিহাসেরও নাম। বাঙালি ভোজনপ্রিয় মানুষ তো বটেই, অতিথি আপ্যায়নে এই মিষ্টির তুলনা নেই। বাঙালির যে কোনো অনুষ্ঠানে অথবা শুভসংবাদে মিষ্টিমুখ করানোর প্রচলন বাঙালি সমাজে চলে আসছে শত শত বছর ধরে। আর সেই মিষ্টি যদি হয় নাটোরের কাঁচাগোল্লা-তবে তো সোনায় সোহাগা। নাটোরের বনলতা সেনের চেয়েও বেশি রয়েছে নাটোরের কাঁচাগোল্লার আন্তর্জাতিক পরিচিতি। আনুমানিক আড়াইশ বছর আগে নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। ১৭৫৭ সাল থেকে এই মিষ্টি ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে। দুবছর আগে দেশের ১৭তম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে নাটোরের কাঁচাগোল্লা। (৪ আগস্ট ২০২৩ ) শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমানের স্বাক্ষরে নাটোর জেলা প্রশাসকের নামে কাঁচাগোল্লার জিআই স্বীকৃতি অনুমোদন দেওয়া হয়।

কাঁচাগোল্লার ইতিহাসঃ কাঁচাগোল্লা গোল নয়, লম্বা নয়, আবার কাঁচাও নয়। তবুও নাম তার কাঁচাগোল্লা! এই নামেই পরিচিত দেশ-বিদেশে। আনুমানিক আড়াইশ বছর আগে নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। সুপ্রাচীনকাল থেকে মিষ্টিরসিকদের রসনা তৃপ্ত করে আসছে এই মিষ্টি। তবে ১৭৫৭ সাল থেকে এই মিষ্টি ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে।

কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির রয়েছে চমৎকার কাহিনি। জনশ্রæতি আছে নিতান্ত দায় পড়েই নাকি তৈরি হয়েছিল এই মিষ্টি। শহরের লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান ছিল নাটোরের প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান। দোকানে বেশ কয়েকটি বড় বড় চুলা ছিল। মধুসূদন এসব চুলায় দেড় থেকে দুমন ছানা দিয়ে রসগোল্লা, পানিতোয়া, চমচম, কালোজাম প্রভৃতি মিষ্টি তৈরি করতেন।

দোকানে কাজ করতেন দশ-পনেরো জন কর্মচারী। হঠাৎ একদিন মিষ্টির দোকানের কারিগর আসেনি। মধুসূদনের তো মাথায় হাত! এত ছানা এখন কী হবে? এই চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে ছানাতে তিনি চিনির রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখতে বলেন। এরপর মুখে দিয়ে দেখা যায় ওই চিনি মেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। নতুন মিষ্টির নাম কী রাখা হবে-এ নিয়ে শুরু হয় চিন্তভাবনা। যেহেতু চিনির রসে ডোবানোর আগে ছানাকে কিছুই করতে হয়নি অর্থাৎ কাঁচা ছানায় চিনির রসে ঢালা হয়েছে, কিন্তু রসগোল্লার ছানাকে তেলে ভেজে চিনির রসে ডোবানো হয়।

তাই তার নামকরণ হয়েছে রসগোল্লা। কাঁচা ছানার রসে ডোবানো হয়েছে বলেই এর নাম দেওয়া হয় কাঁচাগোল্লা। কাঁচাগোল্লার স্বাদ রসগোল্লা, পানিতোয়া, এমনকি সন্দেশকেও হার মানিয়ে দেয়। এর রয়েছে একটি মিষ্টি কাঁচা ছানার গন্ধ যা অন্য কোনো মিষ্টিতে পাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে মিষ্টিরসিকরা এই মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। তখন থেকে মধুসূদন নিয়মিতই এই মিষ্টি বানাতে থাকেন। কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মুধুসূদন পালের দোকানে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন মন ছানার কাঁচাগোল্লা তৈরি হতে লাগল। সে সময় ঢোল বাজিয়ে জানানো হতো কাঁচাগোল্লার কথা।

কাঁচাগোল্লার উপাদান ও তৈরি প্রক্রিয়াঃ খাঁটি দুধের ছানা ও চিনি কাঁচাগোল্লা তৈরির প্রধান উপাদান। ১ কেজি কাঁচাগোল্লা তৈরি করতে প্রায় ১ কেজি কাঁচা ছানা ও ৪০০ গ্রাম চিনির প্রয়োজন। কড়াইতে চিনিগুলো পানিসহ জ্বাল দিতে হয়। চিনি পরিষ্কার করতে সামান্য কাঁচা দুধ দিতে হয়। পরে কড়াইয়ে ছানা ঢেলে দিতে হয়। এরপর জ্বাল এবং একই সঙ্গে কাঠের খুন্তি দিয়ে নাড়তে হয়। এভাবেই ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ধারাবাহিকভাবে নাড়তে নাড়তেই পরিপূর্ণ কাঁচাগোল্লা তৈরি হয়ে যাবে। তবে এই নাড়াচাড়ার মধ্যেই রয়েছে শৈল্পিক কৌশল। মোটামুটি এই হচ্ছে ১ কেজি কাঁচাগোল্লার হিসাব। বর্তমানে ভালো কাঁচাগোল্লা তৈরিতে শহরের প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন ভান্ডারের পরিচালক আরিফুল ইসলাম খান আরিফ জানান, তারা কাঁচাগোল্লাতে এলাচ ব্যবহার করেন না। ফলে প্রকৃত কাঁচা ছানার গন্ধ পাওয়া যায়।

দেশ-বিদেশে কাঁচাগোল্লাঃ ১৭৬০ সালে অর্ধবঙ্গেশ্বরী বাংলার দানশীলা শাসনকর্তা রানি ভবানীর রাজত্বকাল থেকেই নাটোরের কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়াতে থাকে। সেই সময় নাটোরে মিষ্টির দোকান ছিল খুবই কম। এসব দোকানে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ছাড়াও অবাক সন্দেশ, রাঘবশাহী, চমচম, রাজভোগ, রসমালাই, পানিতোয়া প্রভৃতি মিষ্টি ছিল অন্যতম।

তবে এর মধ্যে সবার শীর্ষে উঠে আসে কাঁচাগোল্লা। ফলে সে সময় রাজা এবং জমিদারদের মিষ্টিমুখ করাতে ব্যবহৃত হতো এই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা। এমনকি বিলাতের রাজপরিবার পর্যন্ত যেত এই কাঁচাগোল্লা। তার আগেই এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষের সর্বত্র। সেই সময়ের রাজশাহী গেজেট পত্রিকাতেও কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতির কথা বলা হয়েছে। কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সেই সময় কাঁচাগেল্লার সুখ্যাতি নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। কলকাতা এবং নাটোর শহর একই সময় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ও এই দুই শহরের ঘনিষ্ঠ সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকায় নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ভারত, ইংল্যান্ডসহ তৎকালীন বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই কাঁচাগোল্লা পায় আন্তর্জাতিক পরিচিতি।

কোথায় পাবেন ভালো কাঁচাগোল্লাঃ নাটোরের কিছু উল্লেখযোগ্য দোকান ছাড়া এই মিষ্টি নিলে ঠকার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে নাটোরে কাঁচাগোল্লা বিক্রিতে সর্বশীর্ষে রয়েছে মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডার। এদের রয়েছে নিজের ৪৫টি গাভি। নিজস্ব জমিতে গোখাদ্য হিসাবে এরা ঘাসও চাষ করে। এ ছাড়া নিচা বাজারের শীলা মিষ্টান্ন ভান্ডার, নবরূপ মিষ্টান্ন ভান্ডার, কুন্ড মিষ্টান্ন ভান্ডার, অনুকূল দধি ও মিষ্টান্ন ভান্ডার, মাদরাসা মোড়ের সূর্য মিষ্টান্ন ভান্ডার, লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান এবং স্টেশন বাজারের সকাল-সন্ধ্যা ও ডাব পট্টি ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার।

প্রতারক থেকে সাবধানঃ নাটোরের কাঁচাগোল্লার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় অনেকেই কাঁচাগোল্লার মান ঠিক না রেখে অতি লাভের আশায় ভোক্তাকে ঠকিয়ে করছেন প্রতারণা। নাটোর বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশন এলাকায় কিছু চক্র গড়ে উঠেছে। এরা বাসে বা চলন্ত ট্রেনে কাঁচাগোল্লা বিক্রি করেন। ক্রেতারা এক-দেড়শ টাকা কেজিতেই পেয়ে যায় কাঁচাগোল্লা। বাড়িতে নিয়ে দেখেন ওগুলো কাঁচাগোল্লা নয়, একেবারেই ভেজা ভেজা আটা-ময়দা এবং পচা মিষ্টি দিয়ে তৈরি করা সন্দেশ ইত্যাদি।

এভাবে প্রতারিত হচ্ছেন অনেকে খ্যাতি হারাচ্ছে কাঁচাগোল্লা। এসব হকাররাই নাটোরের কাঁচাগোল্লার অভিশাপ। তাই বাসে-ট্রেনে হকারদের কাছ থেকে কাঁচাগোল্লা কিনে প্রতারিত না হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে নাটোর জেলা প্রশাসন। হকারের বিক্রি করা কাঁচাগোল্লা কখনোই নাটোরের ঐতিহ্যবাহী কাঁচাগোল্লার স্বাদ বহন করে না। এ ব্যাপারে প্রশাসনিক পদক্ষেপ অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছেন নাটোরের জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন।