খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার নৈহাটি ইউনিয়নের আঠারোবাকি নদী সংলগ্ন শ্রীরামপুর বিল। ২ হাজার ৭ শত বিঘা (প্রায় ৯০০ একর) উর্বর কৃষি জমি নিয়ে বিস্তৃত এই বিলকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করেন নৈহাটি, শ্রীরামপুর ও নেহালপুর এলাকার অন্তত ৪ শতাধিক কৃষক। বাজারে তরমুজ, বাঙ্গি, উচ্ছে, চিচিঙ্গা, মিষ্টি কুমড়া সহ শীতকালীন সবজির চাহিদার বড় অংশ পূরণ হয় এখান থেকেই। পাশাপাশি মাছ ও ধানেরও সমৃদ্ধ চাষাবাদ হয়ে থাকে এই বিলে। ২০০৭ সালে আঠারোবিিক নদীর ভাঙন ঠেকাতে বিলের পাশে দু’টি ওয়াপদা বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। একটি ৬৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যের এবং অপরটি ৩২০০ ফুট। একই বছর খালও খনন করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বেড়িবাঁধের সংস্কার না হওয়ায় আজ তা ভাঙনের মুখে। (কিছু জায়গায় ৩ থেকে ৪ ফুট চওড়া) বর্তমানে দুর্বল বাঁধটুকুই কৃষকদের শেষ আশ্রয়। নদীর ওপারের ইটভাটা মালিকদের নদী দখল ও জবরদস্তি কর্মকান্ডের কারণে ভাঙন তীব্রতর হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
স্থানীয় কৃষক মো. মোছের আলী হাওলাদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বেড়িবাঁধের অবস্থা খারাপ শুনে অনেকেই আসে, দেখে যায় কিন্তু কিছুই করে না। আমরা চাষিরা শুধু কান্নাকাটি করি, তবুও কোনো ফল হয় না। নদীর ওপারের ইটভাটা মালিকরা নদী আটকে রেখেছে বলেই এপারের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। আমরা নিজেরা ভাটা মালিকদের জানিয়েছি। আর প্রতিবাদের চেষ্টা করলে নেতারা এসে আমাদের থামিয়ে দেয়।
একই সুরে কথা বলেন কৃষক মো. সাদ্দাম হোসেন। তিনি জানান, আমার পিতা এই বিলে চাষাবাদ করতেন, এখন আমি করি। এখানে ৫-৬শ’ কৃষক মিলে আমরা তরমুজ, বাঙ্গি, করলা, মিষ্টি কুমড়া, ধান ও মাছ চাষ করি। আগে বাঁধের অবস্থা ভালো ছিল। কিন্তু নদী ভাঙনের কারণে এখন তা ভয়াবহ ঝুঁকিতে। বেশিরভাগ কৃষক অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করে, কিন্তু ভাঙনের আতঙ্কে এখন অনেকেই চাষ করছে না। এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সবাই এসেছেন, কিন্তু কথা ছাড়া আর কিছুই দেননি।
শ্রীরামপুর এলাকার কৃষক ইদ্রিস বলেন, আমাদের দিকে কারোর নজর নেই। অথচ এখান থেকে বহু ফসল উৎপাদিত হয়। রাতে ঘুমাতে পারি না। ভয়ে টেনশনে থাকি যদি জোয়ারের পানি চাপে হঠাৎ বাঁধ ভেঙে যায় তবে শুধু বিল নয়, আশপাশের দুই থেকে তিনটি গ্রামও প্লাবিত হওয়ার আশংকা আছে।
চাষি সুমন বলেন, ইটভাটা মালিকরা নদীতে ইটের আদলা ফেলে নদী দখল করেছে। এ কারণে ভাটার ধাক্কা আমাদের দিকে আসছে আর বেড়িবাঁধও ভাঙছে। যে কোনো সময় বাঁধ ভেঙে গেলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে।
নৈহাটি বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও মৎস্য চাষি মুক্তাদির বিল্লাহ ইটভাটা মালিকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, তারা যদি দ্রুত অবৈধ নদী দখল বন্ধ না করে, কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কঠোর আন্দোলনে নামবে। আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই। ইটভাটা মালিকদের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে নদী খনন করে পুরনো গতিপথ ফিরিয়ে আনা হোক, যাতে ভাঙন রোধ হয়।
কৃষক পার্টনার ফিল্ড স্কুলের সভাপতি মো. সাব্বির আহমেদ বলেন, ইটভাটা মালিকরা নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা শ্রীরামপুর বিল সংরক্ষণ বেড়িবাঁধ ভাঙনের কবলে। এতে ৩৬৪ হেক্টর ফসলি জমি হুমকির মুখে। শত শত কৃষক দ্বারে দ্বারে ঘুরছে, কিন্তু প্রতিকারের আশা দেখতে পাচ্ছে না। তবে দায় এড়াচ্ছে সরকারি দপ্তরগুলো।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম বলেন, এই বেড়িবাঁধ আমাদের আওতাধীন নয়। এলজিডির দায়িত্ব। কিন্তু রূপসা উপজেলার এলজিডি প্রকৌশলী শোভন সরকার জানান, বেড়িবাঁধ সংস্কার আমাদের দায়িত্ব নয়। এটা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ। বাজেটও নেই। সরকারি দপ্তরগুলোর এভাবে দায় এড়ানো অবস্থার কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন কৃষকেরা। যেকোনো সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে ৯শ’ একর কৃষিজমি ও অন্তত তিনটি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা অবিলম্বে ওয়াপদা বেড়িবাঁধ সংস্কার, আঠারোবাকি নদী দখলমুক্তকরণ ও অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদের দাবি জানিয়েছেন। তাদের প্রশ্ন -সরকারি দপ্তরের এ দায় এড়ানোর খেসারত কি আমাদের দিতে হবে?