গ্রাম-গঞ্জ-শহর
উপকুলি দুর্যোগ কবলিত এলাকা হয়ে পড়ছে
পাইকগাছায় অস্তিত্ব সংকটে চারটি নদী ও শতাধিক খাল ॥ দুর্যোগ কবলিত হচ্ছে মানুষ
নদী শাসনের নামে অপরিকল্পিত ভাবে পোল্ডার নির্মাণের কারণে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার শিবসা নদী, কপোতাক্ষ নদ, ভদ্রা নদী, দেলুতি নদী ও শতাধিক খাল রয়েছে। ছোট বড় নদ-নদী আজ মৃত, অর্ধমৃত বা মৃত প্রায় হয়ে পড়েছে।
Printed Edition
নদী শাসনের নামে অপরিকল্পিত ভাবে পোল্ডার নির্মাণের কারণে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার শিবসা নদী, কপোতাক্ষ নদ, ভদ্রা নদী, দেলুতি নদী ও শতাধিক খাল রয়েছে। ছোট বড় নদ-নদী আজ মৃত, অর্ধমৃত বা মৃত প্রায় হয়ে পড়েছে। ফলে এলাকার প্রাণ-বৈচিত্র্য তথা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা। যার ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা ও উচ্চ জোয়ারের চাপ সৃষ্ট হওয়ার ফলে উপকূল অতি দুর্যোগ কবলিত এলাকা হিসাবে পরিণত হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারলে এই এলাকায় বসবাস করা যাবে- কিনা সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জোরালো ভাবে।
জানা গেছে, জলোচ্ছাসের হাত থেকে রক্ষার জন্য ৬০’র দশকে উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ প্রকল্পের আওতায় খুলনা অঞ্চলের পাইকগাছা উপজেলার বেশীর ভাগ নদ-নদীকে পোল্ডারের মধ্যে আবদ্ধ রাখা হয়। ফলে সাময়িকভাবে কিছু উপকার পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে সৃষ্ট হয় জলাবদ্ধতা। যা ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের পোল্ডার এলাকার ‘মৃত নদ-নদী’ নামক একটি গবেষণামূলক প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়,
খুলনা জেলার ডুমুরিয়া, ফুলতলা, দাকোপ ও পাইকগাছা, কয়রা উপজেলায় ২৫, ২৭/১, ২৭/২, ১৭/১, ১৭/২, ১৮, ১৯, ২৩ ও ৯নং পোল্ডার অবস্থিত। এ পোল্ডারের প্রধান নদীগুলো হচ্ছে-হামকুড়া, আপার শোলমারী, ভদ্রা, তেলিগাতী-ঘ্যাংরাইল, পশ্চিম শালতা, আমতলী, গুয়াচাপা, হাড়িয়া, গুণাখালী, কড়ুলিয়া ও শিবসা নদী। উল্লিখিত ১৩টি পোল্ডারের মধ্যে ১ নম্বর পোল্ডারে ৮টি অবরুদ্ধ নদী রয়েছে। পাইকগাছায় উপজেলার ৪ টি নদীকে কেন্দ্র করে বয়ে গেছে শতাধিক খাল যাহা আজ অস্তিত্বের সংকটে ভুকছে। তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো ৫০ টি খাল, যা ( ১) ধোনার দোয়ানিয়া খাল (২) বসুখালী খাল (৩) সিলেমানপুর জলকর (৪) কাশিমনগর জলকর (৫) সোনাখালী খাল (চাঁদখালী), (৬) কাটাখালি খাল (লস্কর) (৭) ঠাকুরনবাড়ির খাল (৮) লেবুবুনিয়া খাল (৯) কাটাখালী খাল-১ (চাঁদখালী), (১০) বেতাঙ্গী নদী (বদ্ধ) জলমহাল (১১) ভেটকার খাল(১২) ছিদামখালী খাল (১৩) ধামরাইল খাল (বদ্ধ) জলমহাল (১৪) কালিদাশপুর খাল (১৫) কলমিবুনিয়া (বদ্ধ) জলমহাল (১৬) কাটিপাড়া জলমহাল (১৭) শিববাটি জলমহাল (১৮) হোল্ডিং-২২ (১৯) হরিদাসকাটি জলকর (২০) রামচন্দ্র নগর জলকর (২১) বিলপরানমালি খাল (২২) মটবাড়ি খাল (২৩) পাখিউড়া খাল (২৪) শংকর দানা সীমানা খাল (২৫) হেতালবুনিয়া খাল (২৬) ধোপাখালী খাল (২৭) গোপি পাগলা জলকর (২৮) ফুলবাড়িয়া খাল (২৯) দারম্নন মলিস্নক খাল (৩০) দিঘলিয়া খাল (৩১) মধুখালী খাল (৩২) বাইনবাড়িয়া খাল (৩৩) কলমিবুনিয়া খাল (৩৪) গহরনামের খাল (৩৫) নিমাইখালী খাল (৩৬) সন্যাসী খাল (৩৭) গেওয়াবুনিয়া জলকর(৩৮) চকনোয়াল তলা খাল (৩৯) নিকরির ছোপ খাল (৪০) বগুড়ার খাল, (৪১) আমুরকাটা স্রোতের খাল(৪২) কুমখালী জলকর (৪৩) হরিণখোলা খাল (৪৪) বিগরদানা খাল(৪৫) কানাখালী খাল (৪৬) বাতিখালী খাল (৪৭) মৌখালী খাল (বদ্ধ) জলকর (৪৮) সরেংগা ভরেংগার জলকর (৪৯) পরামর্শ খাল (৫০) বাশতলা খাল। যা আজ অস্তিত্বের সংকটে। পাইকগাছা পানি কমিটির সভাপতি বলেন, জীবিত নদ-নদী ও খালকে রক্ষা ও অবরুদ্ধ নদীগুলোকে যতটা সম্ভব পুণর্জীবিত করতে না পারলে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার আর কোন বিকল্প পথ খোলা নেই। উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করতে হলে নদী বাঁচানো ছাড়া কোন বিকল্প নেই। এ কারণে নদী বাঁচানোকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। খুলনার পাইকগাছা উপজেলা পানি কমিটির সভাপতি বলেন, পুরনো নদীগুলো বাঁচানো গেলে সেটি খুবই ভালো হবে। ইচ্ছামত নদী-খাল দখল হয়ে যাচ্ছে। এতে কারও কোন মাথা ব্যথা নেই। এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। নদীগুলো বাঁচানো গেলে জলাবদ্ধতা থাকবে না, মানুষ স্বস্তির সঙ্গে বসবাস করতে পারবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোল্ডার ব্যবস্থার কারণে নদী ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারেনি। যখন পোল্ডার নির্মাণ করা হয় তখন এলাকার অন্যান্য ভূ-প্রকৃতি এবং পানি ব্যবস্থাপনায় জনগণের অভিজ্ঞতা-এ দুটি বিষয় আদৌ বিবেচনায় নেয়া হয়নি। হুবহু নেদারল্যান্ডস’র পোল্ডার ব্যবস্থা এ দেশে প্রবর্তন করা হয়েছে। ফলে জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। সূত্র জানায়, উপকূল এলাকায় জনগণের পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিটা ছিল প্রকৃতির সঙ্গে এক ধরণের সহাবস্থান পদ্ধতি। স্থানীয়রা পলি ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব বুঝতো। সেকারণে পানি ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল পলি ব্যবস্থাপনা। নদী রক্ষা করতে পারলে জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহেরা নাজনীন বলেন - প্রয়োজনীয়তার নিরিখেই মানুষ এবং ফসল রক্ষায় পোল্ডার নির্মাণ করা হয়। তবে, ভালো করতে গিয়ে কোথাও কোথাও সমস্যা হতে পারে। তবে শুধুমাত্র পোল্ডারের কারণেই নয়, দখলের কারণেও পানির স্রোতের ফ্লো কমে গেছে, পানি প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। যার কারণে নদ-নদীর নাব্যতাও কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সমস্যার উত্তোরণ দিয়ে ভাবতে হবে, গবেষণা করতে হবে। বিশেষ করে নদী ও পানি প্রবাহের কোন ক্ষতি না করে কিভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম করা যায়- সে বিষয়েও চিন্তা-ভাবনার কথা বলেন তিনি।