কাজীপুর (সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা : শীতের আগমনের আভাস মিলতেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার লেপ-তোষক তৈরির কারিগররা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন মাঠে, বাজারে এবং মহল্লার অলিগলিতে চলছে লেপ-তোষক তৈরির কাজ। কেউ দোকানে বসে নতুন লেপ-তোষক বানাচ্ছেন, আবার কেউ তুলা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুরোনো লেপ-তোষক নতুন করে তৈরি করে দিচ্ছেন।
কাজিপুর উপজেলার সোনামুখী, হরিনাথপুর, নাটুয়ারপাড়া, কুমারিয়াবাড়ী, রঘুনাথপুর, জর্জিরা, পানাগাড়ী, চরগিরিশ, আলমপুর, ঢেকুরিয়া, গান্ধাইল, শিমুলদাইড়, ভানুডাঙ্গা, সিমান্তবাজার সহ বিভিন্ন এলাকায় এখন লেপ-তোষক বানানোর ব্যস্ততা চোখে পড়ে। তুলা পরিষ্কার করা, ধুনন, সেলাই, রঙিন কাপড়ে মোড়ানো-সব মিলিয়ে চলছে শীতকে ঘিরে মৌসুমি কর্মচাঞ্চল্য।
সিমান্তবাজারের ধুনকর খলিল মিয়া জানান, এই পেশায় আমি তিন পুরুষ ধরে আছি। আগে লেপ-তোষক তৈরির খুব চাহিদা ছিল, সারা বছরই কাজ পেতাম। কিন্তু এখন শীতের আগের দুই মাস-নভেম্বর ও ডিসেম্বরেই কাজের চাপ সবচেয়ে বেশি থাকে।
তিনি আরও বলেন, আগে একেকটা লেপ (বড়) তৈরি করতে ১৫শ থেকে ১৮শ টাকা খরচ হতো। এখন তুলা, কাপড় আর শ্রমের দাম বেড়ে সেই খরচ দাঁড়িয়েছে ২৫শ থেকে ২৬শ টাকার মতো। ফলে লেপ বিক্রি করে আগের মতো লাভ হয় না। শুধু নতুন লেপ নয়, পুরোনো লেপ-তোষককেও নতুন করে তৈরি করাচ্ছেন অনেকে। শীত আসার আগেই অনেক পরিবার তাদের পুরোনো লেপ খুলে পরিষ্কার তুলা ধুনিয়ে নতুন কাপড়ে সেলাই করাচ্ছেন। এতে খরচ কিছুটা কম পড়ে এবং লেপও আবার নতুনের মতো ব্যবহার করা যায়।
শুভগাছা বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম বলেন, নতুন লেপ কিনতে গেলে খরচ অনেক, তাই পুরোনো লেপটাই ধুনিয়ে বাড়তি কিছু তুলা দিয়ে নতুন কাপড়ে মুড়িয়ে নিচ্ছি। এতে খরচ অর্ধেকেরও কম হবে। লেপ-তোষক তৈরিতে তুলা ও কাপড়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় কারিগরদের খরচও বেড়েছে। তুলা, সুতার দাম ও শ্রমিকের মজুরি মিলিয়ে এখন আগের বছরের তুলনায় খরচ প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি। ফলে লেপের দামও বেড়েছে, যা ক্রেতাদের অর্ডার দিতে কিছুটা নিরুৎসাহিত করছে।
নাটুয়ারপাড়া বাজারের লেপ-তোষক বিক্রেতা আব্দুস সালাম জানান, এখন তুলার দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আগে যে লেপ ১ হাজার টাকায় বিক্রি হতো, এখন সেটি বিক্রি করতে হচ্ছে ১৫শ টাকায়। তাই অনেকেই এখন কম্বল কিনে নিচ্ছেন। বর্তমানে বাজারে দেশি-বিদেশি নানা ধরনের কম্বল পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে ঝুট ও চাইনিজ কম্বল সহজলভ্য ও তুলনামূলক হালকা হওয়ায় অনেকেই তা কিনতে আগ্রহী। ফলে লেপের চাহিদা কিছুটা কমে গেছে।
তবে স্থানীয় কারিগররা বলছেন, কম্বল যতই আসুক, গ্রামের মানুষ এখনো লেপ ছাড়া শীত মানে না। কারণ লেপের উষ্ণতা ও নরম আরাম এখনো অদ্বিতীয়। কাজিপুর পৌরসভা ও উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে প্রায় শতাধিক দোকানে লেপ-তোষক তৈরির কাজ চলছে। এসব দোকানে শুধু লেপ-তোষকই নয়, রেডিমেড কম্বল, বালিশ, কভার ও গদিও বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবছর নভেম্বর মাস থেকে এসব দোকানে ক্রেতার ভিড় বাড়তে থাকে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির প্রথম দিক পর্যন্ত চলে বিক্রির চূড়ান্ত মৌসুম।
শীতের আগমনে কাজিপুরের প্রতিটি গ্রামে এখন লেপ ধুননের শব্দ আর নতুন কাপড়ের ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। রোদে শুকানো তুলার ফাঁকে হাসিমুখে কাজ করছেন ধুনকররা। অনেকের কাছে এটি শুধু একটি পেশা নয়, এটি তাদের জীবনের গল্প, ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার।