২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ প্রাপ্তির পর খুলনা রেলওয়ের জমি দখল এবং চাঁদাবাজিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এমনকি প্লট আকারেও বিক্রি হচ্ছে রেলের জমি। পানি ভর্তি-ডোবা জমির কয়েকটি প্লট ইতোমধ্যেই ভরাট করে সেখানে ঘরও তুলেছেন ক্রেতারা। এছাড়াও অন্যের ঘর দখল করে ভাড়া দিয়ে নিয়মিত চাঁদাও আদায় হচ্ছে রেলওয়ে জমি কেন্দ্রিক। তবে এসব অপকর্মের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ থাকায় অনেকটা ভয়ে মুখ খুলছেন না সংশ্লিষ্টরা।

তবে রেলের জমি ভরাট করে সেখানে ঘর তুলে থাকার কথা স্বীকার করেছেন কেউ কেউ। জমি দখল ও চাঁদাবাজির এ চিত্র রেলওয়ের খুলনা জংশনের আওতাধীন নগরীর জোড়াগেটস্থ মন্টুর কলোনি এলাকার (মৌজা : বানিয়া খামার, জে এল নং-৩, দাগ ১৫০১)।

স্থানীয় সূত্র এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে, জোড়াগেট মন্টুর কলোনি এলাকায় একের পর এক প্লট আকারে অবৈধভাবে রেলওয়ের জমি বিক্রি হচ্ছে। ৩০ থেকে ৪০ হাত পরিমাণের প্রতিটি প্লট বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২৫ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত।

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয় বাসিন্দা মো. জাহিদুল ইসলাম, মো. সাইফুল ইসলাম এবং মুজগুন্নি এলাকার আলমগীর ইতিমধ্যেই তিনটি প্লট দখল করেছেন। রাজনৈতিক পরিচয়ধারী কথিত বিক্রেতারা তাদের কাছ থেকে যথাক্রমে ২৫ হাজার এবং ৫০ হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন।

অনুসন্ধান বলছে, জোড়াগেট এলাকায় বিএনপি’র ইউনিট কমিটি নামে একটি অফিস রয়েছে। যার সভাপতি আব্বাস এবং সেক্রেটারি হায়দার। এই অফিস কেন্দ্রিক নেতা-কর্মীদের বেশ আনাগোনা রয়েছে। নানা বিষয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তার এবং দলবাজি, চাঁদাবাজি ও বিচার-সালিশের নামে এ ইউনিট অফিসে দেনদরবার চলে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।

এই ইউনিট অফিসের সাথে সম্পৃক্ত সদর থানা বিএনপির সদস্য মনির খান ওরফে মইন্না, ২১ নং ওয়ার্ড যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. রবি ওরফে ফর্মা রবি এবং ২১ নং ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য মো. হেলালসহ একটি চক্র রেলওয়ের জমি বিক্রির মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন স্ব-উদ্যোগে। মূলত তাদেরকেই অর্থ দিয়ে জমি দখল, ভরাট বা সেখানে ঘর তুলছেন ক্রেতারা।

ক্রেতা জাহিদুল ইসলাম রেলের জমি দখলের বিষয়টি স্বীকার করলেও কাউকে কোন টাকা দেননি বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, বসবাসের জন্য রেলের পুকুর আকারে থাকা কিছু জমি ভরাট করে তিনি নিয়েছেন। এভাবে তার মত অনেকেই নিয়েছেন। তবে রেলের প্রয়োজন হলে এ জমি ছেড়ে দেবেন তিনি। জমি দখল বাবদ কাউকে টাকা দেয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করলেও কথিত বিক্রেতা মনির খান, রবি ও হেলালকে চেনেন এবং তারা এলাকার ভাই ব্রাদার বলে উল্লেখ করেন তিনি। এমনকি জমি দখলের বিষয়টি তারা জানেন এবং তারা তাকে এখানে ঘর তুলে থাকতে বলেছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জোড়াগেট এলাকায় ইতোপূর্বে কাবিল শেখের ছেলে মো. আজিম উদ্দিন রেলের জমি দখল করেন। পরবর্তীতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তাকে ৬ হাজার ৪শ’ টাকা জরিমানা করেন।

এর বাইরেও স্থানীয় ইউনুসের গ্যারেজ, রশিদের দোকান, আলামিনের হোটেল এবং জব্বার কমান্ডারের দোকান ও পুকুরের জমি ইতোমধ্যে দখল হয়ে গেছে। এমনকি জোড়াগেটস্থ কেসিসির কাঁচা বাজারের আড়ৎ এবং ট্রাক স্টান্ড কেন্দ্রিক ১০-১৫ টি দোকান থেকেও প্রতি মাসে মোটা অংকের চাঁদা তোলা হয়।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর ২১ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শামসুজ্জামান স্বপনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আব্দুল জব্বার ওরফে জব্বার কমান্ডারকে এলাকায় থাকতে দেয়ার শর্তে তার স্ত্রী ফিরোজা বেগমের কাছ থেকে এক লাখ টাকা চাঁদা নেয়া হয়। এমনকি পরবর্তীতে আরও তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয় তার স্ত্রীর কাছে। একইভাবে স্থানীয় যুবলীগ কর্মী কামালের কাছ থেকেও চাঁদা হিসেবে গ্রহণ করা হয় ৮০ হাজার টাকা। এছাড়া কুট্রি নামে অপর এক যুবলীগ নেতার কাছ থেকে গ্রহণকৃত চাঁদা পরবর্তীতে ছাত্র-জনতার চাপে চাঁদাবাজরা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় বলে সূত্র জানিয়েছে। আব্দুল জব্বার ওরফে জব্বার কমান্ডারের সঙ্গে চাঁদা দেয়ার বিষয়ে কথা হলে তিনি তা অস্বীকার করেন। বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তবে তার স্ত্রীর কাছ থেকে কোন চাঁদা নেয়া হয়েছে কিনা বা দাবি করা হয়েছে কিনা সেটিও তাকে জানানো হয়নি। তবে পট পরিবর্তনের পর থেকে তিনি এলাকায় অবস্থান করছেন না উল্লেখ করে বলেন, বর্তমানে টেকনাফে অবস্থান করছেন। সেখানে তিনি তার ভাইয়ের ছেলের ঠিকাদারি কাজ দেখাশুনা করছেন বলে উল্লেখ করেন। তবে যুবলীগ কর্মী কুট্টির কাছ থেকে কাছে চাঁদা দাবীর বিষয়টি তিনি শুনেছেন বলে উল্লেখ করেন।

খুলনা সদর থানা বিএনপির সদস্য মনির খান, যুবদল নেতা রবি এবং ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য মো. হেলাল অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন। দাবি করেন, তারা এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না। তবে রেলের জমি অনেকেই দখল করে ঘর তুলে থাকছেন বলে দাবি করেন তারা। যদিও রেলওয়ে জমি বিক্রি, দখল এবং চাঁদাবাজির সঙ্গে তারা জড়িত না বলে দাবি করেন।

এসব ব্যাপারে রেলওয়ের খুলনার ফিল্ড কর্মকর্তা (কানুনগো) মো. শহিদুজ্জামান বলেন, রেলের জমি দখল করে প্লট আকারে বিক্রির বিষয়টি তার জানা নেই। তবে তিনি এ বিষয়ে লোক পাঠিয়ে খোঁজ নেবেন উল্লেখ করে বলেন, এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটে থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।