খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা ও আশপাশের কৃষকেরা প্রমাণ করেছেন পরিশ্রম, সঠিক দিকনির্দেশনা আর নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করলে ভাগ্যের চাকা ঘোরানো সম্ভব। একসময় পতিত জমি আজ লাখো টাকার ফসল দিচ্ছে। অফসিজন তরমুজ এখন শুধু ফল নয় বরং গ্রামের মানুষের সোনালী স্বপ্ন ও সম্ভাবনার প্রতীক। বটিয়াঘাটা উপজেলার চারদিকে সবুজ লতাগুল্মে মোটা, সবুজ-কালো ডোরাকাটা তরমুজ উঁকি দিচ্ছে। কৃষকেরা সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত এ ফলের পরিচর্যায়। যে জমি কয়েক বছর আগেও পতিত পড়ে থাকত, আজ সেই জমি থেকে আসছে লাখো টাকার আয়। কৃষকের মুখে হাসি, চোখে স্বপ্ন এ যেন খুলনায় কৃষির নতুন অধ্যায়। এ বছর উপজেলার সুরখালী ইউনিয়নে খড়িয়াল, রায়পুর, সুরখালী, ভগোবতিপুর, সুন্দরমহল, শম্ভুনগর, বারোআড়িয়া, কোদলা, বুনারাবাদ, নাইনখালী, পার্শেমারী, বারোভুঁইয়া, সানকেমারী, চান্দরড্ঙ্গাা এবং জলমা ইউনিয়নের রাঙ্গেমারী গ্রামের প্রায় ৬৪০ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। যার বাজারমূল্য ধরা হচ্ছে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা। শুধু টাকার অঙ্কে নয়, কৃষকের জীবনে এ চাষ এনেছে নতুন স্বপ্ন, নতুন সম্ভাবনা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে খুলনায় ৯৬৬ হেক্টর জমিতে অফসিজন তরমুজ আবাদ হয়েছে। সম্ভাব্য উৎপাদন প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন। শুধু বটিয়াঘাটাতেই ৬৪০ হেক্টর জমিতে এখন অফসিজন তরমুজ চাষ হচ্ছে। পাশাপাশি রূপসা, পাইকগাছা ও দিঘলিয়ায়ও এ আবাদ দ্রুত বিস্তার লাভ করছে।
সাফল্যের গল্প বলতে গিয়ে স্থানীয় কৃষক আব্দুল মজিদ বলেন, আগে ধান করে দুই বিঘা জমিতে এক মওসুমে ২০ হাজার টাকা হাতে পেতাম। এখন সেই জমিতে তরমুজে আয় হচ্ছে দুই লাখ টাকা। খরচ বাদ দিলেও এক লাখ টাকার বেশি থাকে। কৃষির প্রতি আস্থা বেড়েছে। গৃহিণী থেকে কৃষক হওয়া রুবিনা বেগম জানান, সংসারে অভাব ছিল, মেয়ের পড়াশোনা চালানো কঠিন ছিল। এখন তরমুজ বিক্রি করে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া চালাতে পারছি। আমরা আর পিছিয়ে নেই। অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের হিসাবে, এক বিঘা জমিতে গড়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। অথচ বিক্রি করে আয় হয় এক লাখ টাকারও বেশি। খরচ বাদ দিলেও তিন থেকে চার গুণ লাভ থাকে। এই লাভজনকতার কারণেই দিন দিন বাড়ছে কৃষকের আগ্রহ।
বটিয়াঘাটার কৃষকদের এ সাফল্যে কৃষি বিভাগের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জীবানন্দ রায় বলেন, অল্প সময়ে কম খরচে যে কয়েকটি ফসল থেকে কৃষক লাভবান হতে পারেন, অফসিজন তরমুজ তার মধ্যে অন্যতম। কৃষকদের এখন আমরা আরও উদ্বুদ্ধ করছি যাতে ঘেরের পাড়ে পতিত জমি কাজে লাগানো যায়।
গাওঘরা ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা অঞ্জন কুমার বিশ্বাস জানান, রাজাখাঁ বিলে এ বছর প্রায় ৫০০ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। মাত্র দুই বছর আগেও এ বিলে ছিল শুধু ধান আর মাছ। তখন মাত্র ৬ জন কৃষক চাষ করতেন। এ বছর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০ জনে। তিনি বলেন, কৃষকেরা এখন শুধু নিজের পরিবারের প্রয়োজনই মেটাচ্ছেন না বরং গ্রামীণ অর্থনীতিতেও অবদান রাখছেন।
তরমুজ শুধু আয়ের উৎস নয়, স্বাস্থ্যকর ফল হিসেবেও জনপ্রিয়। এতে রয়েছে ভিটামিন এ, সি, বি-৫, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম। শরীর ঠান্ডা রাখা, হজমে সহায়তা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কার্যকর। আগে গরমের মওসুমে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন সারাবছরই বাজারে মিলছে তরমুজ।
কৃষি বিভাগের সহায়তা অধিদপ্তরের খুলনা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা শুধু বীজই দিচ্ছি না, মাঠে গিয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সেচ, সার প্রয়োগ, রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। অফসিজন তরমুজের সাফল্যের কারণে আমরা এ আবাদ আরও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়েছি।
বিসিআরএল প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. লোকমান হোসেন মজুমদার বলেন, খুলনার পাশাপাশি বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাতেও এ প্রকল্পে তরমুজ চাষ হচ্ছে। কৃষকেরা ভালো দাম পাচ্ছেন। আগামীতে আরও বড় পরিসরে আবাদ হবে। অফসিজন তরমুজ চাষে কৃষকেরা ব্যবহার করছেন মালচিং পলিথিন যা জমির আর্দ্রতা ধরে রাখে ও আগাছা কমায়। ড্রিপ সেচ পদ্ধতি, এতে পানির সাশ্রয় হয়, গাছের শিকড়ে সঠিকভাবে পানি পৌঁছায় এবং উন্নত হাইব্রিড বীজ যা ফলন ও গুণগত মান বাড়ায়। তরুণ কৃষক রাশেদুল জানান, করোনার সময় শহর থেকে গ্রামে ফিরে এসে তরমুজ চাষ শুরু করি। মালচিং পদ্ধতিতে এখন বছরে কয়েক লাখ টাকা আয় হয়। কৃষিতে যে এত সম্ভাবনা আছে আগে বুঝিনি। চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে তবে সবকিছুই মসৃণ নয়। কৃষকেরা কয়েকটি সমস্যার কথা বলেছেন, যেমন বাজারে দামের অস্থিরতা, কখনো অতিরিক্ত উৎপাদনে দাম পড়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতির ঝুঁকি। সংরক্ষণাগারের অভাব, ফলে দ্রুত বিক্রি করতে হয়। রূপসার কৃষক শেখ কামাল বলেন, ভালো ফলন হলেও যদি দাম না পাই তাহলে ক্ষতি হয়। সরকার যদি ঠান্ডা গুদামের ব্যবস্থা করে, আমরা আরও লাভবান হবো।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে রূপান্তরিত তরমুজ চাষ শুধু কৃষক পরিবার নয়, স্থানীয় অর্থনীতিতেও পরিবর্তন আনছে। জমিতে শ্রমিক, পরিবহনকর্মী, বাজারে বিক্রেতা, সব মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান। শ্রমিক দেলোয়ার হোসেন বলেন, আগে দিনমজুরি করতে দূরে যেতে হতো। এখন গ্রামে তরমুজের মওসুমেই কাজ পাই। আয়ও ভালো হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অফসিজন তরমুজ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি বৈচিত্র্য ও অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। সঠিক পরিকল্পনা ও বাজার ব্যবস্থাপনা থাকলে এ ফল রফতানির পথও খুলে যাবে।