২০১৮ সালের ৭ নবেম্বর ২ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের অনুমোদন পায়। প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ফুয়েলিং সিস্টেম স্থাপন, একটি পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পৃথক সাব-স্টেশন স্থাপন, নিরাপত্তার জন্য ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম ও যাত্রীদের জন্য এসকালেটরসহ আরও আনুষঙ্গিক কিছু কাজ রয়েছে। এই মেগা প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালে। পরবর্তী সময় বর্ধিত সময় অনুযায়ী ২০২৩ সালের ২৭ মে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজ শুরু করতে গিয়ে দেখা যায়- নকশায় ত্রুটি রয়েছে। তখন কাজ বন্ধ করে প্রকল্পের নকশা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংশোধিত নকশায় বেশকিছু সংযোজন-বিয়োজন করা হয়।
নকশার ত্রুটির কারণে এর মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। অথচ এ পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ২২ শতাংশ। তাই নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৭ সাল পর্যন্ত। ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৭০ কোটি টাকা। এতে প্রকল্পের মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়াল ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকায়। ইতোমধ্যে সংশোধন করা হয়েছে প্রকল্পের নকশাও। নতুন করে তৈরি করা হয়েছে ডিপিপি। জানা যায়, প্রকল্পটির সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদনের জন্য একনেকে পাঠানো হয়েছে। চলতি মাসেই সংশোধিত প্রকল্পটি একনেকে উঠবে। তবে এ সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কাজ বন্ধ থাকার কারণে চার বছর ধরে অযতেœ-অবহেলায় নষ্ট হয়েছে সম্প্রসারণ প্রকল্পের নানা সরঞ্জামাদি। দীর্ঘদিন খোলা জায়গায় মাটিতে পড়ে থাকার কারণে রডের মানও নষ্ট হয়েছে।
বেবিচক সম্প্রতি এ প্রকল্প নিয়ে একটি বৈঠক করেছে। বৈঠকে বেবিচকের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেশের তৃতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সিলেটের মোট জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বসবাস করে। বিদেশে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিমানবন্দরগুলোতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই যাত্রী ও বিমান চলাচলের সংখ্যা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রগুলো বেশিরভাগ সিলেট অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এবং শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ সহজলভ্য হওয়ায় সিলেট অঞ্চলে ব্যাপকহারে শিল্পায়ন হচ্ছে। ফলে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রী পরিবহন চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে।
সভায় তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইয়ুশিন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন অ্যান্ড হীরিম আর্কিটেক্টস অ্যান্ড প্ল্যানার্স কোম্পানি লিলিমিটেড জেভি (ইয়ুশিন-হীরিম জেভি) সিলেট বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের নকশা তৈরি করে। নকশার ভিত্তিতে ২ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের ডিপিপি ২০১৮ সালের ৭ নবেম্বর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। ঠিকাদার নিয়োগের দরপত্র প্রক্রিয়াকরণ শেষে ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদনের পর ২০২০ সালের ১৯ এপ্রিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপের সঙ্গে বেবিচকের চুক্তি হয়। চুক্তির শর্তানুযায়ী ঠিকাদারকে নির্ধারিত মোবিলাইজেশন অ্যাডভান্স পরিশোধ ও প্রকল্প কাজের এলাকা হস্তান্তর করে ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট হতে প্রকল্পের মাঠপর্যায়ের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের কাজ শুরুর পর চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের ডিজাইন রিভিউ করার সময় প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবনের মেজনাইন ফ্লোরের উচ্চতা কিছু জায়গায় প্রয়োজনের তুলনায় কম দেখা যায়। পরবর্তী সময় মূল ডিজাইনার ইয়ুশিন-হীরিম জেভির মাধ্যমে ওই ভবনের ডিজাইন সংশোধন করা হয়। সংশোধিত ডিজাইন অনুযায়ী প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবনের কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে ওই ভবনের পাইলিং, ফাউন্ডেশন ও বেজমেন্টের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছে।
উল্লেখ্য, ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রচলিত আইকাও গাইডলাইন অনুসরণ করে প্রকল্পের মাস্টারপ্ল্যান ও বিস্তারিত ড্রয়িং-ডিজাইন তৈরির কাজ সম্পাদন করা হয়েছিল। মূল মাস্টারপ্ল্যানে বিমানবন্দরের এয়ারসাইডের পানি নিষ্কাশনের জন্য রানওয়ে ও টেক্সিওয়ের মাঝে একটি কাভার্ড ড্রেন অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও ওপেন ড্রেনের তুলনায় কাভার্ড ড্রেন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়বহুল, তথাপি তৎকালীন আইকাও গাইডলাইন অনুযায়ী জায়গার সীমাবদ্ধতা থাকায় মাস্টারপ্ল্যানে উল্লিখিত কাভার্ড ড্রেন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময় যেখানে রানওয়ে সাইড স্ট্রিপের ন্যূনতম প্রস্থ ১৫০ মিটার হতে ১০ মিটার কমিয়ে ১৪০ মিটার করা হয়। ফলে বিদ্যমান জায়গার মধ্যেই রানওয়ে ও টেক্সিওয়ের মধ্যবর্তী স্থানে ওপেন ড্রেন নির্মাণের সুযোগ তৈরি হয় এবং সে মোতাবেক প্রকল্পের মাস্টারপ্ল্যান সংশোধনের প্রয়োজন হয়। সংশোধিত মাস্টারপ্ল্যানে প্রকল্পের আওতায় নির্মিয়মান প্যারালাল টেক্সিওয়েটি মূল ডিজাইন থেকে ল্যান্ড সাইডের দিকে ১০ মিটার স্থানান্তরিত হয় এবং অ্যাপ্রোনের প্রস্থ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল বিল্ডিংসহ অন্যান্য স্থাপনা ২০ মিটার স্থানান্তরিত হয়। এতে প্রকল্পের অ্যাপ্রোন, টেক্সিওয়ে, কারপার্ক, অ্যাপ্রোচ রোড প্রভৃতি স্থাপনার ডিজাইনগুলো পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়।
গত ২ জুলাই সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সভায় আইকাও-এর হালনাগাদ নীতিমালা পুনর্গঠিত ডিপিডিতে সংযুক্ত করা, প্রকল্পটি ডিসেম্বর, ২০২৭-এর মধ্যে শেষ করা, স্থাপনাগুলোর পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধির তথ্য ও ব্যয় বিভাজনসহ বিস্তারিতভাবে পুনর্গঠিত ডিপিপিতে করা এবং ব্যয় বৃদ্ধি যৌক্তিকতা উল্লেখ করা, কার্গো বিল্ডিং ও নতুন ফায়ার স্টেশন নির্মাণকাজ বাদ দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরা, ২০ কার্যদিবসের মধ্যে পুনর্গঠিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যাসহ ৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে পুনর্গঠিত ডিপিপি প্রেরণ করা না হলে উদ্যোগী মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আগ্রহী নয় বলে বিবেচিত হবে বলে সিদ্ধান্তও হয়।
সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্প কাজের ধীরগতি, ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক সাংবাদিকদের বলেন, আমি এখানে নতুন যোগ দিয়েছি। প্রকল্প-সংক্রান্ত সার্বিক বিষয়টি পর্যালোচনা করছি। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে বোঝার পর প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।