মোহাম্মদ জাফর ইকবাল, সুনামগঞ্জ (হাওড়) থেকে ফিরে : ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল/বাতাসের আছে কিছু গন্ধ/রাত্রির গায়ে জ্বলে জোনাকি/তটিনীর বুকে মৃদু ছন্দ’। এই গানের দৃশ্যটিই বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে লাল শাপলার হাওড় বিকিবিলে। সকালে পূর্ব আকাশে সূর্যের রক্তিম আলোকছটাকেও হার মানায় বিকিবিলসহ আশপাশের রক্তিম লাল শাপলা। পানির ওপর ফুলে ফুলে সাজানো লালগালিচা বিছায়ে ডাকছে। এর সঙ্গে রয়েছে দেশীয় নানা প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির সুর। প্রকৃতি তার রূপের সঙ্গে নিজে বাদ্যযন্ত্রে সুরের ঝরনাধারা ছড়িয়ে দিয়ে আশপাশের পরিবেশ ও গ্রামগুলোকে মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে মেঘালয় পাহাড় সংলগ্ন এই হাওড়ে।

হাওড়ে বেড়ানোর কথা ভাবলেই সুনামগঞ্জের নামটি সবার ভাবনায় চলে আসে। বর্ষা কিংবা হেমন্ত দুই সময়েই রুপে-গুণে অনন্য পাহাড় আর হাওড়াঞ্চলের জন্য বিখ্যাত সুনামগঞ্জ। বর্ষায় চারদিক থাকে পানিতে থই থই, আবার হেমন্তে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঠ। দুই সময়ে দুই রূপ। সুনামগঞ্জকে সবাই চিনে ‘হাওড়কন্যা’ বলেই। অবশ্য এর পেছনে আছে নয়নাভিরাম টাঙ্গুয়ার হাওড়। হাওড়, নদী, পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্যের মেলবন্ধনের পাশাপাশি সুনামগঞ্জকে পর্যটকদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিতি দিয়েছে লাল শাপলাও। জেলার প্রতিটি এলাকায় এই লাল শাপলা যে কারো মন-মগজে প্রশান্তি আনার জন্য যথেষ্ট। শান্ত-নিরিবিলি এই হাওড়ের পানিতে যেন চাদরের মতো বিছিয়ে আছে শাপলা ফুল। আর সেই বিলের পানিতে যদি ছোট একটি নৌকা নিয়ে আপনি ভেসে পড়েন তাহলে পাবেন এক অন্য অনুভূতি। চারপাশে শাপলা, পাখির হালকা কিচিরমিচির আর পানির নীরবতা, আপনাকে যেন অন্য জগতে নিয়ে যাবে। যা আমাদের জাগতিক জগত থেকে একদম অন্যরকম। রোদের তাপে নুইয়ে পড়ে বলে ভোরের সূর্য উঠার আগেই লাল শাপলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন নানা প্রান্তের প্রকৃতিপ্রেমীরা।

একপাশে মেঘালয় আর অন্যপাশে পূর্ব আকাশে উদিত সূর্যের রক্তিম আলোকে হার মানিয়ে পানির বুকে ফুটে উঠেছে লক্ষাধিক শাপলা। দূর থেকে দেখে মনে হবে এ যেন জলের বুকে কেউ লাল শাপলার চাদর মুড়িয়ে দিয়েছে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই ফুটতে শুরু করা এসব শাপলা দেখতে ছুটে আসেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় দৃষ্টিনন্দন লাল শাপলার বিলে দেখা মেলে এমন সৌন্দর্য।

সূত্র মতে, ভৌগোলিক দিক থেকে হাওড় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে আলাদা। মানুষের জীবনযাত্রা ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতিও এখানে ভিন্ন। বছরের বেশির ভাগ সময় হাওড় থাকে পানিমগ্ন। থই থই পানির ওপর তখন ছোট ছোট গ্রামগুলো ভাসে দ্বীপের মতো। এই সময়ে দ্বীপে গজিয়ে ওঠা লাল শাপলা পর্যটকদের বাড়তি আনন্দ প্রদান করে। মনমুদ্ধকর লাল শাপলার দৃশ্য যে কারো মন কাটবেই।

সুনামগঞ্জে প্রতিবছর যেসব পর্যটক ঘুরতে আসেন তাদের বেশির ভাগই তাহিরপুর উপজেলায়। এই উপজেলায় পাশাপাশি বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান আছে, যেগুলো পর্যটকদের কাছে খুবই প্রিয়। এই উপজেলায় এলে একসঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওড়, এই হাওড়ের উত্তর পাড়ের শহীদ সিরাজ লেক, নিলাদ্রী পার্ক, স্বাধীনতা উপত্যকা, লাকমাছড়া, টেকেরঘাটের নয়নাভিরাম ছোট ছোট টিলা, স্মৃতিসৌধ, মহেষখলার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ, বারিক টিলা, শাহ আরেফিন (র.) এর আস্তানা, শ্রী অদ্বৈত মহাপ্রভুর মন্দির, শিমুল বাগান এবং যাদুকাটা নদীর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এসব দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে যাওয়ার পথে পথে যে কারো দৃষ্টি কাটবে হাওড়ের লাল শাপলার মায়াবতী চাহনী।

একঘেয়ে জীবন থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে দেশের দর্শনীয় স্থানে ঘুরার কোনো বিকল্প নেই। আপনার চোখ জোড়াকে বাড়তি প্রশান্তি দিতে চাইলে সুনামগঞ্জের আশপাশেই থাকা শাপলা বিল ঘুরে আসার বিকল্প নেই। সাধারণত বছরের এই সময়টায় বাংলাদেশের পুকুর, হ্রদ, বিল কিংবা অন্যান্য স্থানের পানিতে ফোটে শাপলা। দেশের প্রায় সব জায়গাতেই শাপলা ফোটে, কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় সৌন্দর্য হয় অতুলনীয়। নান্দনিক দৃশ্যমূল্যের কথা বাদ দিলেও শুষ্ক মৌসুমের পর জলাশয়গুলোয় শাপলার অপরূপ দৃশ্য ফিরে আসা যেন সেখানে প্রাণ ফিরে আসার মতো ব্যাপার। শুধু জলাশয়গুলোতেই নয়, উজ্জ্বল রঙের এই শাপলা যেন আশপাশের পুরো এলাকাতেই প্রাণ ফিরিয়ে আনে।

সমুদ্রের মতো বিস্তীর্ণ জলরাশি, যেটি ঢেউয়ের বদলে হাজালো লাল শাপলা আর সবুজ পাতায় আচ্ছাদিত! হেমন্তকাল থেকে শরতের মধ্যভাগ পর্যন্ত সুনামগঞ্জের বিস্তুর্ণ হাওড়ের আশপাশ পরিণত হয় শাপলার সমুদ্রে, যেখান থেকে চোখ ফেরানো দায়। এই জলাশয়গুলোর অবস্থান বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মেঘালয়ের পাদদেশে। একপাশে পাহাড়, তার নিচেরই বিস্তীর্ণ জলরাশি যা ভরে আছে লাল শাপলায়, সব মিলিয়ে যেন এক জাদুকরী দৃশ্য তৈরি হয়। এই হাওড় ঘুরতে গেলে কেবল শাপলার সৌন্দর্যই আপনাকে মুগ্ধ করবে না, সেখানে থাকা পরিযায়ী পাখি যেমন পিনটেইল হাঁস, সারস বা মাছরাঙ্গার ঝাঁকও আপনাকে হাওড়ে স্বাগত জানাবে। হাওড়ের এই বিশাল এলাকাজুড়ে ফুটে থাকা অগণিত শাপলা যে কারও চোখ জুড়াবে। প্রতিদিনই হাওড় পরিদর্শনে আসা হাজারো মানুষ এই শাপলার দৃশ্য উপভোগ করেন আপন মনে। অনেকেই নৌকায় চেপে ফুলের কাছাকাছি ঘুরে আসেন।

দর্শনার্থী রোজি বলেন, আমি মূলত হাওড়ের মুগ্ধতা দেখতে এসছিলাম। কিন্তু এখানকার বাড়তি সৌন্দয্য হচ্ছে এই লাল শাপলা। বাস থেকে নেমে হাওড়ে যাবার পথে পথে এই লাল শাপলার সৌন্দর্য আমাকে বিমোহিত করেছে। শাপলা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি।

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী তৌশি বলেন, এত লাল শাপলা আমি কখনো দেখি নাই। হাজার হাজার লাল শাপলা ফুল ফুটেছে। প্রকৃতি যেন অন্যরকম সাজে সেজেছে। দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে। অনেক দিন ধরে ইচ্ছা ছিল লাল শাপলার সাথে ছবি তুলব, আজ ইচ্ছাটাকে পূর্ণতা দিলাম। ভোরবেলায় লাল শাপলাগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। লাল শাপলার রাজত্ব মনকে প্রফুল্ল করে তুলেছে।

সুনামগঞ্জের হাওড় ঘূরে দেখা গেছে, হাওড়ের পানির ওপর ফুটে আছে লাল শাপলা। সবকিছু মিলিয়ে প্রকৃতিকে ভিন্ন এক রূপে সাজিয়ে তোলা হয়েছে যেন রং-তুলির আঁচরে। তাই যেন সৌন্দর্যমণ্ডিত বৃহত্তর সিলেটের লাল শাপলা দেখতে পর্যটকদের ভিড় প্রতিনিয়ত বাড়ছে। হাওড়ের পানিতে ঘুরে বেড়িয়ে মুগ্ধ হচ্ছেন পর্যটকরা। হাওড়ের বিভিন্ন এলাকায় ফুটে থাকা অজস্র লাল শাপলার রূপে মজে থাকার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আর নৌকা দিয়ে বিলের মাঝখানে গেলে তো কথাই নেই। লতাপাতা-গুল্মে ভরা বিলের পানিতে ভেসে থাকা হাজার হাজার লাল শাপলার মাঝে নিজেকে স্বর্গরাজ্যের বাসিন্দা মনে হবে। প্রকৃতির আপন খেয়ালে গড়ে ওঠা সৌন্দর্য বুঝি এমনই হয়। ভোরবেলা দূর থেকে দেখলে মনে হবে প্রকৃতি লালগালিচা বিছিয়ে পর্যটকদের বরণ করতে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এ ডাক উপেক্ষা করা সাধ্য কার! এর মধ্যে বালিহাঁস, পাতি সরালি, পানকৌড়ি, নীলকণ্ঠী, সাদা বক, জল ময়ূরসহ অসংখ্য প্রজাতির পাখির উপস্থিতিতে তখন নতুন রুপ দেখা যায় শাপলা বিলের।

লাল শাপলা শুধু সৌন্দর্যই নয়, বিল থেকে শাপলা তুলে অনেক এলাকার বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন এলাকার কয়েকটি দরিদ্র পরিবার। ডিসেম্বর মাসে শীতের শুরুতে হাওড়ের পানি কমে যায়। তখন শাপলা গাছও মরে যায়। সে সময় কৃষকেরা এখানে বোরো ধান চাষ করেন। জানা গেছে, অন্য এলাকায় শাপলা বিক্রি করলেও সানামগঞ্জ এলাকায় সেভাবে কেউ বিক্রি করেনা বলে জানা গেছে।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার কাশতাল এলাকায় অবস্থিত লাল শাপলার বিকি বিলকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বিকি বিলে তাকালে মনে হবে লাল গালিচা বিছানো। পানির দেখা মিলবে পরে। যে দিকে চোখ যায়, শুধু লাল শাপলা। যেন লাল শাপলার মেলা বিলজুড়ে। পাহাড়ের কাছে হাওড়ের এমন সৌন্দর্য স্থানীয়দের তো বটেই, মুগ্ধ করছে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লোকজনকেও। তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট বাজার থেকে কাশতাল গ্রামের পাশে গেলেই চোখে পড়ে এই বিল। বাদাঘাট বাজার থেকে দূরত্ব এক কিলোমিটারের মতো হবে। সড়কের বাঁ পাশে বিকি বিল। ডানে তাকালে চোখে পড়বে মেঘালয় পাহাড়। পাহাড়ের ওপরে মেঘের খেলা। হাওড়-পাহাড়ের সৌন্দর্য এখন এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বিলে শাপলার ফাঁকে ফাঁকে ছোট নৌকায় করে ঘুরছেন লোকজন। কোমর সমান পানিতে নেমে শালুক তুলছে আশপাশের গ্রামে নারী ও শিশুরা।

স্থানীয় বাদাঘাট এলাকার বাসিন্দা আহসান হাবিব কাওছার জানান, তাহিরপুর এমনিতেই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য খুব আকর্ষণীয় স্থান। এর মধ্যে বিকি বিলজুড়ে লাল শাপলার এমন সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে, এত দিন এটি অনেকের নজরে আসেনি। এখন মানুষ জেনে দেখতে আসছেন। তিনি জানান, আগস্ট থেকে নভেম্বর এই চার মাস মূলত লাল শাপলা থাকে। লাল শাপলার সৌন্দর্য দেখতে হলে সকালে আসতে হবে।

স্থানীয়রা জানান, অক্টোবর মাসজুড়ে বিলে এই ফুলগুলো থাকবে। পানি কমলে জমিতে বোরো ধান আবাদ করবেন। তবে দর্শনার্থীরা অক্টোবরের ভেতর আসলে এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারবেন। সুনামগঞ্জ আব্দুজ জহুর সেতু থেকে মোটরসাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। ব্রিজ থেকে বাদাঘাট পর্যন্ত মোটরসাইকেলের ভাড়া লাগবে তিনশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ টাকার মতো। বাদাঘাট বাজারে থেকে কাশতাল গ্রামে যাওয়ার জন্য ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। বাদাঘাট থেকে সর্বোচ্চ দেড়শ টাকা খরচ হবে বিকিবিল পর্যন্ত যেতে। কাশতাল গোদারা ঘাটে নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। আপনি চাইলে হেঁটে বা নৌকায় করে ঘুরতে পারবেন। এছাড়া সেখানে হাউসবোডও ভাড়া পাওয়া যায়।

জানা গেছে, ২০১৯ সালে লাল শাপলার বিকি বিলকে হাওড় পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন সুনামগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুল আহাদ। পরে পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য নতুন এলাকা হিসেবে বিকি বিলে একটি সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় ১৪ দশমিক ৯৫ একর জায়গা নিয়ে গঠিত এই বিলের প্রাকৃতিকভাবেই জন্মায় শাপলা। বিকি বিলে লাল শাপলার পাশাপাশি জন্মে সাদা ও বেগুনি রঙের শাপলাও। এর বাইরে জেলার বিস্তৃর্ণ হাওড়ে দেখা মেলে লাল শাপলার।