কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও অসচেতন নাগরিকদের কার্যক্রমের কারণে পানি, বাতাস ও মাটি প্রতিনিয়ত দূষণের শিকার হচ্ছে। এতে পরিবেশ ও কৃষি জীববৈচিত্র গুরুতর ঝুঁকিতে পড়েছে।
কুষ্টিয়ার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট বড় ৬টি নদী। এর মধ্যে রয়েছে- পদ্মা, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, হিশনা, কালিগঙ্গা নদী ও কুমারনদ। তবে গড়াই ও কালিগঙ্গা নদী সবচেয়ে বেশি দূষণের কবলে পড়েছে।
জানা যায়, কুষ্টিয়া জেলার ১৫টি বড় শিল্প কারখানার মধ্যে ১৩টির ব্যবহৃত বিষাক্ত পানি বাধাহীনভাবে গড়াই ও কালিগঙ্গা নদীতে মিশছে।
কুষ্টিয়া, কুমারখালী ও খোকসা পৌরসভার ময়লা পানি ফেলার একমাত্র স্থান হলো গড়াই নদী। বিশেষ করে কুমারখালীর কাপড়ের ডাইং ফ্যাক্টরির দূষিত পানির শেষ আশ্রয়স্থল এই গড়াই নদী।
পানির দূষণের কারণে নদীতে দেশি মাছ দেখা দুষ্কর হয়ে গেছে, পাখি ও অন্যান্য প্রাণী কুলও লোপ পাচ্ছে। মাছের অভাবে গড়াই পাড়ের জেলেরা পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া দূষিত পানির কারণে কৃষিতে নদীর পানি ব্যবহারও কমে গেছে।
এদিকে জেলায় বাড়ছে বায়ু দূষণের প্রবণতাও। জেলার মোট ১৯১টি ইট ভাটা তালিকাভুক্ত থাকলেও কিš‘ বাস্তবে এর সংখ্যা আরও বেশি। ইট ভাটাগুলো প্রচুর দূষণ সৃষ্টি করছে। জেলার রাইস মিলগুলোও প্রতিদিন কালো ধোঁয়া ছড়াচ্ছে।
সেখানকার বজ্র মিলগুলো থেকে গড়ি ক্যানেলগুলোর মাধ্যমে আবাদী জমিতে গিয়ে পড়ছে। খাজানগরের প্রায় মিলগুলোতেই বজ্র নিস্কাশনের ব্যবস্থা নেই। এতে দারুণভাবে নষ্ট হচ্ছে স্বাভাবিক পরিবেশ। মিলগুলোতের ছাই উড়ে দারুণভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
চালকলের বর্জ্যে ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে খাজানগর-কবুরহাট এলাকার পরিবেশ। মিলের বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাচ্ছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ খাল। দুর্গন্ধযুক্ত খালের কালচে পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করায় নষ্ট হচ্ছে ফসল। মারাত্মক দূষণের কারণে এলাকার পুকুর-জলাশয়ের মাছ মরে যাচ্ছে। আর খালের পানিতে মেশা বর্জ্যের দুর্গন্ধে এলাকার মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ভারী এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের একটিরও বর্জ্য শোধনাগার না থাকায় মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এই এলাকার জীববৈচিত্র্য।
কুষ্টিয়ার খাজানগরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধান-চালের মোকাম। বটতৈল ইউনিয়ন থেকে শুর“ করে খাজানগর, কবুরহাট হয়ে আইলচারা পর্যন্ত বড় আকারের অর্থাৎ ভারী অটোমেটিক রাইসমিল রয়েছে ৫৫টি। আর হাসকিং এবং প্রসেসিং মিলিয়ে মিলের সংখ্যা প্রায় ৪৫০টি। এর মধ্যে বর্তমানে প্রায় সাড়ে তিনশর মতো মিল চালু রয়েছে।
এসব রাইচ মিলের কোনোটিরই নিজস্ব বর্জ্য পরিশোধনাগার নেই। মিলের দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত পানি পাইপের মাধ্যমে সরাসরি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের খালে। যা চলে যাচ্ছে কৃষি জমিতে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন। আবার পুকুরের মাছ মরে ভেসে উঠছে। দূষিত পানির সঙ্গে ধানের চিটা, কুঁড়া ও ছাই থাকায় মুহূর্তের মধ্যেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে খালগুলো।
দূরের রাইসমিলগুলোও পাইপ লাইনের মাধ্যমে বর্জ্যের সংযোগ রেখেছে খালের সঙ্গে। রাইসমিলের এসব বর্জ্য খালের পানিতে মিশে একদিকে যেমন পানিকে দূষিত করছে অন্যদিকে মারাত্মক পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ছে এই এলাকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।
রাইসমিলের কারণে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ ওই এলাকার বাসিন্দারা। স্থানীয়রা জানান, এই এলাকার মানুষের ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। খালের পানিতে রাইসমিলের বর্জ্য এসে মেশায় খালের দুর্গন্ধে গোটা এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে।
এছাড়াও ঘরবাড়ি-গাছপালা সব ঢাকা পড়ে যাচ্ছে কালো ছাই আর ধুলায়। এলাকার জলাধারগুলো পচা পানি আর তুষ-ভুসিতে জমাট বাঁধা নর্দমায় পরিণত হয়েছে। এতে করে অসহনীয় জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার বটতৈল-খাজানগর-পোড়াদহ এলাকায়।
এ ছাড়া দুটি বৃহৎ তামাক কোম্পানির প্রসেসিং প্লান্ট এবং ৩৮টি মাঝারি শিল্প, বিশেষ করে প্লাইউড মিলগুলোও বায়ু দূষণ করছে।
জেলার মিরপুর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় অতিরিক্ত লাভের আশায় কৃষকরা তামাক চাষে ঝুঁকছেন। তামাক চাষে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া ইট ভাটাগুলো কৃষকের জমির উপরিভাগ চড়া দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। সচেতনতার অভাবে কৃষকেরা কৃষি জমিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছে, যার ফলে মাটি ক্রমশ দূষিত হচ্ছে।
জেলার বাসিন্দারা আশঙ্কা করছেন, দূষণরোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পানি, বাতাস ও মাটির দূষণ ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ আকার নেবে। তারা বলছেন, দ্রুত পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে প্রশাসনসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে।
কুষ্টিয়ার পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. ইমদাদুর হক জানান, জেলায় পানি, বাতাস ও মাটির দূষণ পরিমাপের যন্ত্র নেই। তবে পরিবেশ রক্ষা ও দূষণ রোধে মিল ও কারখানাগুলোতে অভিযান চালানো এবং সাধারণ কৃষক ও মিল মালিকদের পরামর্শ ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দূষণ কমানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহম্মদ আরেফিন বলেন, ‘পরিবেশ বান্ধব মিল ও কারখানা গড়ে তোলার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দিষ্ট সময়সীমা দেয়া হবে। যারা পরিবেশ রক্ষায় ব্যর্থ হবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।