বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা এখন থেকে এলসিএল পদ্ধতিতে আমদানি-রফতানির সুযোগ চালু করেছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এই বহুল প্রত্যাশিত সুবিধা বাস্তবায়নের ফলে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ—সকল শ্রেণির ব্যবসায়ীরা সমানভাবে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী মোংলা বন্দরের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করতে পারবেন।
বিশেষত যেসব ব্যবসায়ী এতদিন একটি সম্পূর্ণ কনটেইনার ভরে পণ্য আমদানি করার সামর্থ্য না থাকায় এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন, তাদের জন্য এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
নতুন এই সুবিধার অধীনে একাধিক আমদানিকারক চাইলে একই কনটেইনার ভাগাভাগি করে পণ্য আনতে পারবেন। পাশাপাশি আমদানীকৃত পণ্য বন্দরের ইয়ার্ড বা ওয়্যারহাউজে সংরক্ষণ করে পরে কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ছাড় করিয়ে নেওয়ারও সুযোগ রাখা হয়েছে।
এর আগে মোংলা বন্দরে শুধুমাত্র এফসিএল পদ্ধতিতে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এ ব্যবস্থায় একটি কনটেইনার সম্পূর্ণরূপে একক কোনো আমদানিকারককে ব্যবহার করতে হতো। ফলে যারা ছোট পরিসরে ব্যবসা করেন বা যাদের পণ্য কনটেইনার ভর্তি করার মতো পর্যাপ্ত ছিল না, তারা কার্যত এই বন্দরের সুবিধা ভোগ করতে পারতেন না।
এ কারণে বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাধ্য হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর বা অন্যান্য রুট ব্যবহার করতেন। দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবসায়ীরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন, যাতে একাধিক আমদানিকারক যৌথভাবে একই কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পান। কিন্তু এতদিন সেই দাবিতে কোনো সাড়া মেলেনি।
গত জুন মাসে মোংলা বন্দর কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে এলসিএল সুবিধা চালুর জন্য মোংলা বন্দর চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত আবেদন করা হয়। পরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান বন্দরে পরিদর্শনে এলে অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মো. মোশাররফ হোসেন বিষয়টি বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করেন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। তখন এনবিআর চেয়ারম্যান মৌখিকভাবে এ প্রস্তাবে সম্মতি দেন।
অবশেষে চলতি মাসের ৭ আগস্ট মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক (ট্রাফিক) মো. কামাল হোসেন স্বাক্ষরিত একটি আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের জানানো হয় যে তারা এখন থেকে এলসিএল সুবিধার আওতায় মোংলা বন্দরের মাধ্যমে পণ্য আমদানি-রফতানি করতে পারবেন।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এলসিএল সুবিধা বাস্তবায়নের জন্য বন্দরে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো যেমন ওয়্যারহাউজ, স্টাফিং ও আনস্টাফিং শেড এবং কায়িক পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা সহজে তাদের পণ্য সংরক্ষণ, পরীক্ষা ও ছাড় করানোর সুযোগ পাবেন। এলসিএল পদ্ধতি মূলত তখনই কার্যকর হয় যখন কোনো একক আমদানিকারকের পণ্য পুরো কনটেইনার ভর্তি করার মতো হয় না। সে ক্ষেত্রে একাধিক আমদানিকারক মিলে একই কনটেইনার ভাগাভাগি করে পরিবহন করতে পারেন। এটি আন্তর্জাতিকভাবে ‘গ্রুপেজ শিপিং’ নামে পরিচিত এবং বিশ্ব বাণিজ্যে বহুল ব্যবহৃত একটি সাশ্রয়ী আমদানি-রফতানি পদ্ধতি।
মোংলা বন্দর কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এতদিন কনটেইনারভিত্তিক আমদানির সুযোগ না থাকায় মোংলা বন্দরের সুবিধা নিতে পারেননি। কিন্তু এখন এলসিএল সুবিধা চালুর ফলে তারা যৌথভাবে কনটেইনার ভাগাভাগি করে সহজেই তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য আনতে পারবেন। তিনি এজন্য মোংলা বন্দর চেয়ারম্যান এবং এনবিআর চেয়ারম্যানকে ধন্যবাদ জানান। অন্যদিকে, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক মো. মাকরুজ্জামান মুন্সি জানান, এলসিএল সুবিধা চালুর ফলে ব্যবসায়ীদের মোংলা বন্দরের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এখন বন্দর ব্যবহারে উৎসাহিত হবেন, এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি দেশের বাজারে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে, যা মূল্য নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
মোংলা বন্দরে এলসিএল সুবিধা চালুর মাধ্যমে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা নতুন করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেন। এটি শুধু আমদানি-রফতানির প্রক্রিয়া সহজ করবেই না, বরং সামগ্রিক অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং দেশের রাজস্ব ও বাজারদর উভয় ক্ষেত্রেই সুফল বয়ে আনবে।