খুলনা বিভাগের শতাধিক নদ-নদীর মধ্যে অনেকগুলোর অস্তিত্ব আজ প্রায় বিলুপ্ত। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তথ্যমতে, খুলনা বিভাগে বর্তমানে ১৩৮টি নদী চিহ্নিত রয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ৩৭টি নদী রয়েছে চরম অস্তিত্ব সংকটে এবং ২০টিরও বেশি নদীর প্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।

খুলনা বিভাগের ঐতিহ্যবাহী নদীর অনেকগুলো আজ শুকনো খালে পরিণত হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন,বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং জল-প্রবাহ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র যৌথভাবে ২০২৪ সালের শেষে খুলনা বিভাগের আটটি জেলায় নদীভিত্তিক এক জরিপ পরিচালনা করে। এই জরিপে ৮ জেলার ১৩৮টি নদীর মধ্যে ৩৭টি নদী ‘গভীর সংকটে’ এবং ২০টি নদী সম্পূর্ণ প্রবাহহীন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। নদীভিত্তিক জীবিকা, কৃষি, পানীয় জল ও নৌযান চলাচল সবই এর ফলে হুমকির মুখে। উল্লেখযোগ্য সংকটাপন্ন নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে শোলমারী, চুনকুড়ি, রূপসা, ভদ্রা, ময়ূর, হামকুড়া, পশুর, মুক্তেশ্বরী, হরিহর, ইছামতি, গড়াই, কালিগঙ্গা, কপোতাক্ষ, মধুমতি, নবগঙ্গা, চিত্রা, বেতনা, আটারোবাঁকি, খোলপেটুয়া, ঘ্যাংড়াই, শিবশাহ, লাবণ্যবতী, চুণা প্রভৃতি। এছাড়া গড়াই, কপোতাক্ষ, মধুমতি, ইছামতি, চিত্রা ও শিবসা নদীর প্রবাহ আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে বা বর্ষাকাল ব্যতীত সময়ে পানিশূন্য হয়ে থাকে।

খুলনা জেলার ভদ্রা, রূপসা, শিবসা, ময়ূর নদীর অর্ধেক প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। বাপা খুলনা শাখা বলছে, শহর এলাকায় ময়ূর নদীর ৪০% অংশ দখল হয়ে গেছে। সাতক্ষীরা জেলার চুনকুড়ি, খোলপেটুয়া, ইছামতি নদীর পানি এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নেই বললেই চলে। মাছ ধরা বন্ধ হওয়ায় অন্তত ৩৫০০ পরিবার বিকল্প পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছে।

যশোর ও ঝিনাইদহ জেলার ভৈরব, চিত্রা, নবগঙ্গা নদীর নাব্যতা কমে গেছে ৬০% (সার্ভে ২০১০ ও ২০২৪)। বড় নৌযান চলাচল এখন একেবারেই বন্ধ। বাগেরহাট জেলার পশুর নদীতে লবণাক্ততা বেড়েছে ৩৫% গত ১০ বছরে (পানি উন্নয়ন বোর্ড, খুলনা)। মারাদি, তালেশ্বর নদী প্রায় হারিয়ে গেছে। কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা: গড়াই, মাথাভাঙ্গা, কুমার নদীর প্রবাহ শুষ্ক মওসুমে ২০% এর নিচে। সুন্দরবন অঞ্চলের পশুর, বলেশ্বর, শিবসা নদীতে লবণাক্ততা ও দূষণ ব্যাপক হারে বেড়েছে।

নদী শুকিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ সমূহ মধ্যে রয়েছে নদীর তীরে ও তলদেশে অবৈধ দখল করে ঘরবাড়ি, দোকান, ইটভাটা ও অন্যান্য স্থাপনা গড়ে ওঠায় প্রাকৃতিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণ নদীর স্বাভাবিক জলচক্র বাধাগ্রস্থ করছে। বছরের পর বছর নদীগুলোর তলদেশে পলি জমে নাব্যতা হারিয়েছে। জলবায়ুর প্রভাবের ফলে বর্ষার সময়ও কিছু নদীতে পানি থাকে না। শিল্পবর্জ্য ও দূষণ নদীতে শিল্পবর্জ্য ও রাসায়নিক পদার্থ নিক্ষেপে নদীর বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়ছে। কৃষি ও শিল্পের প্রয়োজনে নদী থেকে ব্যাপক হারে পানি তোলায় নদীর গভীরতা ও প্রবাহ কমেছে।

সূত্র জানায়, পানি সংকটে কৃষি উৎপাদন ২০-২৫% কমেছে (কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর, ২০২৩), চিংড়ি, গজাল, পাবদা ও বেলে মাছের ঘাটতি ৭০%, খুলনা অঞ্চলে ৪৮টি অভ্যন্তরীণ নৌপথের মধ্যে এখন মাত্র ১১টি সচল রয়েছে। খুলনা শহরের ৩৫% ও সাতক্ষীরার ৪২% বাসিন্দা বিশুদ্ধ পানির জন্য বিকল্প উৎসের ওপর নির্ভরশীল (উচঐঊ জরিপ ২০২৩)। কৃষি, পরিবেশ ও জীবনযাত্রা আজ বিপন্ন। সূত্র আরও জানায়, কৃষিতে বিপর্যয় পানি সংকটে সেচ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, মাগুরা অঞ্চলে ধান, সবজি, পাটসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। নদী নির্ভর মাছ যেমন পুঁটি, টেংরা, শোল, চিংড়ি বিলুপ্তির পথে। অনেক প্রজাতির মাছের প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হয়েছে। নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় খুলনা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী নৌপথ যোগাযোগ প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। নদীর প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে, ফলে নগর ও গ্রামে বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতা এবং দীর্ঘমেয়াদী বন্যা দেখা দিচ্ছে। বিশুদ্ধ পানির সংকট, অর্থনৈতিক ক্ষতি ও পরিবেশগত অবক্ষয় জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. জাফর ইকবাল চৌধুরী বলেন,“নদীর ভরাট ও দখল সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সুন্দরবনের নদীগুলোতেও লবণাক্ততা ও দূষণ বেড়ে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে।”

নদী রক্ষা কমিশন সদস্য মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, “নিয়মিত ড্রেজিং, বাঁধ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং স্থানীয়দের সম্পৃক্ত না করলে খুলনা বিভাগে জলবায়ু সংকট আরও ব্যাপকভাবে ঘনিয়ে আসবে।”

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির নেটওয়ার্ক মেম্বার ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের খুলনা শাখার সমন্বয়কারী এডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, দখল, দূষণ, উজন প্রবাহে বাধা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, শ্রেণী পরিবর্তন করে মৎস চাষেরে নামে প্রবাহমান নদীগুলোতে বাধ দিয়ে গতিপ্রবাহ বিনষ্ট করা ফলে নদীগুলো মৃত বা মৃত পর্যায়ে চলে গেছে। এজন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ ন্যায্য হিস্যা আদায় পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে সুনির্দিষ্ট যে আইন গুলো রয়েছে তার বাস্তবায়ন দরকার। এছাড়া নদীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে সমাজের সকল শ্রেণীর জনসাধারনকে নিয়ে কাজ করতে হবে।

পরিবেশবীদদের মতে, দ্রুত নদীতীর থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে প্রাকৃতিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা জরুরি। নিয়মিত ও পরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, নদী উৎসব ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। আইন বাস্তবায়ন বিদ্যমান নদী সংরক্ষণ আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ এবং নদী কমিশনের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পগুলো পুনরায় মূল্যায়ন করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।

খুলনা বিভাগের নদীগুলো শুধু পানি নয়, এগুলো ইতিহাস, জীববৈচিত্র্য ও জীবিকার উৎস। যদি এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে পরিবেশগত বিপর্যয় শুধু খুলনা নয়, গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে বিপন্ন করে তুলবে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী আন্তর্জাতিক, যেগুলোর উৎস ভারতের পাশাপাশি নেপাল ও চীনে। উৎস দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে নদীর উৎসমুখে এবং মাঝপথে বাঁধ নির্মাণ, প্রবাহ ঘুরিয়ে দেওয়া, ও পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উজানের পানিপ্রবাহ না থাকায় নদীগুলোর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি নদীর তীরবর্তী জনপদ, কৃষি এবং জীববৈচিত্র্য পড়ছে মারাত্মক হুমকির মুখে। একদিকে উজানে পানির সংকট, অন্যদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ভাটিতেও সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। লবণাক্ত পানি নদীতে ঢুকে পড়ছে, যা কৃষিজমি, মিঠা পানির মাছ, এবং পানীয় জলসংকট সৃষ্টি করছে। এ দ্বিমুখী চাপের ফলে খুলনা অঞ্চলের নদীগুলো আর নদী হিসেবে টিকতে পারছে না পরিণত হচ্ছে মরা খালে। উজান-ভাটির সংকট ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরেও চলছে নদী হত্যার উৎসব। খুলনায় নদীগুলোকে পরিকল্পিতভাবে দখল করা হচ্ছে। সরকারি নথিতে নদীর শ্রেণী পরিবর্তন করে অনেক ক্ষেত্রে খাল হিসেবে দেখানো হচ্ছে, ফলে সেগুলো লিজ দেওয়া সহজ হচ্ছে। এরপর লিজগ্রহীতারা সেসব প্রবাহমান নদী বা খাল বাঁধ দিয়ে জলাশয়ে রূপান্তর করছেন এবং সেখানে মাছ চাষ করছেন। এতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট হচ্ছে এবং আশপাশের পরিবেশও বিনষ্ট হচ্ছে।