আষাঢ়ের শুরুতেই মওসুমে প্রথম ভারী বর্ষণে তলিয়ে গেছে খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা। সোমবার রাতভর বৃষ্টিতে নগরীর প্রধান সড়কগুলো হাঁটুপানিতে ডুবে যায়। নি¤œাঞ্চল ও বহু এলাকার বাসাবাড়ি-দোকানপাটে পানি ঢুকে পড়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী। খুলনা আবহাওয়া অফিস তথ্যনুসারে, গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা সৃষ্টি এবং দক্ষিণ-পশ্চিম মওসুমি বায়ূ সক্রীয় থাকার উপকূলীয় এলাকা তথা দক্ষিণাঞ্চলে মাঝারী হতে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যহত রয়েছে। সোমবার সকাল ৬ হতে মঙ্গলবার সকাল ৬ পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ৩৬ মিঃমিঃ এবং মঙ্গলবার সকাল ৬ টা থেকে দুপুুর ১২ টা পর্যন্ত ৪৩ মি. মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ অবস্থা আরো ২/৩ দিন অব্যহত থাকতে পারে।

নগরবাসীর অভিযোগ, খুলনা নগরীর পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম ২২টি খাল দখলমুক্ত ও সংস্কার না করা, নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার না করা এবং জলাধার ভরাট হয়ে যাওয়াতেই মাঝারী বা ভারী বৃষ্টিপাতে তলিয়ে যাচ্ছে খুলনা নগরী, পিছু ছাড়ছেনা দুর্ভোগ। এছাড়া উন্নয়ন কাজ সঠিকভাবে ও দ্রুত সম্পন্ন না হওয়ার দরুন বর্ষা মওসুমে দুর্ভোগ আরো বাড়ছে। নগরবাসীর দাবি, জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থার পাশাপাশি দ্রুত উন্নয়নকাজ করতে হবে, নতুবা সামনে দিনে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন তারা।

বিশেষজ্ঞ ও নাগরিকেরা বলছেন, শত শত কোটি টাকা খরচ করে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও অপরিকল্পিত উন্নয়ন, খাল দখল ও নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার না করায় এই দুর্ভোগের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। একই সাথে ভৈরব ও রূপসা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীর পানিধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি নদীতে নামতে পারছে না, বরং জোয়ারের সময় শহরের পানি আরও বাড়ছে। এছাড়া নগরীর পশ্চিমাঞ্চলের বিল পাবলা ও রায়ের মহলের মতো প্রাকৃতিক জলাধারগুলো আবাসন ব্যবসায়ীরা ভরাট করে ফেলায় বৃষ্টির পানি জমার আর জায়গা নেই, যে কারণে এই খুলনার এই জলাবদ্ধতার নিরসন হচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।

সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে ও ২০২৩ সালে নির্বাচিত সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের মূল প্রতিশ্রুতি ছিল জলাবদ্ধতা নিরসন। জলাবদ্ধতা নিরসনে ৮২৩ কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প হাতে নেন তিনি। গত সাড়ে পাঁচ বছরে এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৬’শ কোটি টাকা খরচ করে নগরীর বিভিন্ন ড্রেন নির্মাণ ও সাতটি খাল খনন করা হয়েছে। এরপরও নগরবাসী সুফল না পাওয়ায় প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সুধী সমাজের ব্যক্তিবর্গ।

ঘুরে দেখা গেছে, আষাঢ়ের শুরুতেই মওসুমে প্রথম ভারী বর্ষণের কারণে অফিসগামী মানুষ, শিক্ষার্থী ও খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েন। নগরীর নতুন রাস্তা মোড়, খুলনা বিশেসায়িত হাসপাতাল মোড়, মুজগুন্নি মোড়, বাস্তহারা, আহসান আহমেদ রোড, রয়েল মোড়, খানজাহান আলী সড়ক, বাইতিপাড়া, চানমারী, লবণচরা ও টুটপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, রূপসা নতুন বাজারের মতো এলাকাগুলোতে হাটুপানি জমে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন স্থানীয় এলাকার সড়কে, খানাখন্দে পানি জমে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ভারী বর্ষণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে সর্বস্তরের মানুষের স্বাভবিক চলাচল ব্যাহত হয়েছে।

স্কুল শিক্ষার্থী আরিক বলেন, গতকাল রাত থেকে টানা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় পানি জমেছে। আগামী মঙ্গলবার থেকে পরিক্ষা শুরু হচ্ছে, তাই ছাতা নিয়েও ব্যাচে যেতে হয়েছে। পরীক্ষা না হলে এমন বৃষ্টির মধ্যে ব্যাচে যেতাম না। চারদিকে স্যাঁত স্যাঁতে কাদা।

প্রাইভেট চাকুরিজীবি সুমন বলেন, সকালে রেইন কোর্ট পড়ে মোটরসাইকলে নিয়ে অফিসরে কাজে বের হয়। রয়েল মোড়ে হাটুপানি। আামার মোটরসাইকেলের অর্ধেকটাই ডুবে গিয়েছিল পানিতে। অবশেষে দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে কর্মস্থলে পোচ্ছালে হয়েছে।

দোলখোলা এলাকার বাসিন্দা সোহেল বলেন, আমাদের এলাকায় সড়ক ও ড্রেন নির্মানের কাজ চলছে, কিন্তু কাজের ধীরগতির কারণে বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে যায়। সরু সড়কে যান চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। বিক্রয় প্রতিনিধি জাকির বলেন, আষাঢ় মাস শুরু হয়েছে, মওসুমের প্রথম বর্ষায় খুলনা হাটুপানি। সামান্য বৃষ্টি হলেই খুলনা সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। খুলনার চারদিকে এতো উন্নয়ন, যেদিকে তাকাই ড্রেনের কাজ চলছে তো চলছে। তারপরও সামান্য বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার হাত থেকে রেহাই মেলে না। জলাবদ্ধতা নিরসনে পরিকল্পিত কাজ করলে দূর্ভোগ কমবে বলে আমি মনে করি।

সু-শাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনা মহানগর সাঃ সম্পাদক এডভোকেট কুদরত-ই খুদা বলেন, ভৈরব ও রূপসা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীর পানিধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি নদীতে নামতে পারছে না, বরং জোয়ারের সময় শহরের পানি আরও বাড়ছে। এ ছাড়া, নগরীর পশ্চিমাঞ্চলের বিল পাবলা ও রায়ের মহলের মতো প্রাকৃতিক জলাধারগুলো আবাসন ব্যবসায়ীরা ভরাট করে ফেলায় বৃষ্টির পানি জমার আর জায়গা নেই। খুলনার জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের জন্য সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিৎ বলে আমি মনে করি। বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, শত শত কোটি টাকা খরচ করে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও অপরিকল্পিত উন্নয়ন, খাল দখল ও নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার না করায় কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় দূর্ভোগ পোহাচ্ছে নগরবাসী। খুলনার জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের জন্য সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিৎ।

রিকশাচালক সালাম বলেন, বহুবছর ধরে পরিবার নিয়ে খুলনায় থাকি। রিক্সা চালিয়ে এই খুলনায় জীবন কাটিয়ে দিলাম। কয়েক বছর ধরে খুলনায় একটু ভারী বৃষ্টি হলে পানিতে ডুবে যায়, এত ড্রেন আর কালভার্ট হয়েছে, কিন্তু কোনোটা দিয়েই পানি নামে না। জলাবদ্ধতা হলে আমাদের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু মালিককে ঠিকই গুনে গুনে টাকা বুঝে দিতে হয়। কেসিসির প্রধান প্রকৌশলী মশিউজ্জামান খান বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রকল্পের আওতায় পাম্প স্টেশন ও স্লুইসগেট সংস্কারের মতো কিছু কাজ এখনো বাকি আছে। এগুলো শেষ হলে নগরবাসী সুফল পাবে। খুলনা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. মিজানুর রহমান জানান, গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা সৃষ্টি এবং দক্ষিণ-পশ্চিম মওসুমি বায়ূ সক্রীয় থাকার উপকূলীয় এলাকা তথা দক্ষিণাঞ্চলে মাঝারী হতে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যহত রয়েছে। সোমবার সকাল ৬ হতে মঙ্গলবার সকাল ৬ পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ৩৬ মি. মি. এবং মঙ্গলবার সকাল ৬ টা থেকে দুপুুর ১২ টা পর্যন্ত ৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ অবস্থা আরো ২/৩ দিন অব্যহত থাকতে পারে।