এম এ কাইয়ুম চৌধুরী, শিবালয় (মানিকগঞ্জ): মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার পয়লা ইউনিয়নের ছোট বরুরিয়া গ্রামের বাসিন্দারা প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে শাঁখা তৈরি করে আসছেন। তবে গত দুই দশকে অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদার ঘাটতি, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, পুঁজিসংকটসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে আজ এ শিল্পটি সংকটে পড়েছে। আগে গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা শাঁখা তৈরির কাজ করলেও বর্তমানে মাত্র ১৫-২০টি পরিবার শাঁখা তৈরির কাজ করছে।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে সেন, দত্ত ও কর পরিবার এ শিল্পের ভিত্তি স্থাপন করে। তখন শ্রীলঙ্কা ও ভারত থেকে শঙ্খ এনে সেগুলো থেকে শাঁখা তৈরি করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হতো। বরুরিয়া গ্রামে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে শাঁখা তৈরি করছেন। সারা দিন ধরে শঙ্খ থেকে শাঁখা তৈরি, পলিশ করা এবং নকশা আঁকতে ব্যস্ত থাকেন তারা। বর্তমানে এক জোড়া শাঁখা আকার ও মানভেদে ২০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, স্থানীয় বাজারে কিছুটা চাহিদা থাকলেও এই শিল্পের সঠিক বিকাশের জন্য সরকারের সহায়তা প্রয়োজন।
শাঁখা তৈরির কাজ করা উজ্জ্বলা রানী সেন বলেন, ‘ছোট ছেলের বয়স যখন তিন মাস, তখন আমার স্বামী মারা যান। ছেলে এখন একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসার চালাতে শাঁখার কাজ শিখি। সেই কাজ করেই কোনো রকমে চলছে আমাদের জীবন। আগে অনেক কাজ ছিল। এখন তা চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়।’
শাঁখা তৈরির কারিগর আনন্দ কর বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি। এখন শাঁখারও চাহিদাও কমে গেছে। এর ফলে আমাদের আয় কমে গেছে। এখন আকার ও মানভেদে এক জোড়া শাঁখা ২০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।’
অপর কারিগর গোপেন্দ্র নাথ দত্ত বলেন, ‘আমাদের এই শিল্প অনেকটাই স্থবির হয়ে গেছে। আমাদের ভারত থেকে শঙ্খ আমদানি করতে হয়। এতে অনেক টাকা লাগে। আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় বাধ্য হয়ে চড়া সুদে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয়। শাঁখা বিক্রি করে যে টাকা লাভ হয় তার বড় একটা অংশ ঋণ পরিশোধ করতেই চলে যায়। তাই এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।’
গোপেন্দ্র নাথ দত্তের স্ত্রী সুনিতা দত্ত বলেন, ‘ঘরে-বাইরে আমরা দুজনে এই কাজ করি। আমি শাঁখার ডিজাইন করতে পারি না তাই তাকে সাহায্য করার জন্য শাঁখার পলিশ, প্যাকেট করার কাজগুলো করে দিই। এতে করে নিজেদের একটু সাশ্রয় হয়। তবে আগের মতো আর কাজ নেই। আমাদের খুব সমস্যা হচ্ছে।’
একই গ্রামের সুবোধ সেন বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের কাজ নেই বললেই চলে। আগে আমাদের গ্রামের প্রায় সবাই এই কাজ করতেন। এখন আমরা ১৫-২০ জন এই কাজ করি। আগের চেয়ে চাহিদা কমে গেছে, শঙ্খের দাম বেড়েছে আর আমাদেরও পুঁজির সমস্যা থাকায় এই কাজ করে লাভ হচ্ছে না। এখন অন্য কিছু করার নেই তাই এ কাজ করে কোনো রকম টিকে আছি। আমরা চাই, সরকার আমাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ বা সহায়তা প্রদান করুক, যেন এই ঐতিহ্য বজায় রাখতে পারি।’
জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন,‘আমি বরুরিয়া গ্রামে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলব। ঘিওরের এই শাঁখাশিল্প সংরক্ষণ, উন্নয়ন, অনলাইন বাজার সৃষ্টি, পুঁজি সমস্যা সমাধানসহ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যাবতীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।