জুলাই বিপ্লবের টালমাটাল বছরে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ইতিহাস গড়েছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম। সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বন্দরে আমদানি-রফতানি মিলিয়ে ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭ টিইইউস (২০ ফুট সমমান কনটেইনার) হ্যান্ডলিংয়ের মধ্য দিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এটি বন্দরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের নজির। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, পূর্ববর্তী অর্থবছর ২০২৩-২৪ সালে এই পরিমাণ ছিল ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯০ টিইইউস। ফলে বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ০৩ শতাংশ।
বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে এই সাফল্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। গেল বছরের জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন, ইন্টারনেট শাটডাউন, মহাসড়ক অবরোধ এবং সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে প্রায় এক মাস চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসে। এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রুত কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবুও একের পর এক সংকট মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকতে হয় বন্দর কর্তৃপক্ষকে। হঠাৎ বন্যা, পণ্য পরিবহণে ধর্মঘট, কাস্টমসে কর্মবিরতি ও টানা ঈদ ছুটির প্রভাবও কম ছিল না।
তবুও বছরের শেষে দেখা গেল, সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে বন্দর গড়েছে রেকর্ড। ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারে পণ্য পরিবহণ শুরু হওয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ হ্যান্ডলিংয়ের বছর। বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, “গণঅভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দিয়ে বছর শুরু হলেও আমরা ধৈর্য ও কৌশলের মাধ্যমে কার্যক্রম চালিয়ে গেছি। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সংস্কার ও অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দিয়েছি।”
তিনি আরও জানান, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় আমদানি-রফতানির গতি বেড়েছে। এ ছাড়া সকল পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই এই অর্জনের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। বন্দর কর্মকর্তারা জানান, নৌপরিবহন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেনের সরাসরি নির্দেশনায় বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয় ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ হওয়ায় কনটেইনার ডেলিভারির গতি বেড়েছে। পাশাপাশি, অটোমেশন সার্ভিস, ই-গেট পাস ও কনটেইনার অপারেটিং সিস্টেম আধুনিকীকরণের ফলে কার্যক্রম আরও গতিশীল হয়েছে।
প্রসঙ্গত, দেশের আমদানি-রফতানিকেন্দ্রিক সমুদ্রবাণিজ্যের ৯২ শতাংশ এবং কনটেইনার ও পণ্য পরিবহণের ৯৮ শতাংশই সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। বিশ্বখ্যাত ‘লয়েডস লিস্ট’-এর ২০২৪ সালের তালিকায় বিশ্বের ১০০ ব্যস্ততম বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৬৭তম। গত কয়েক বছরের হ্যান্ডলিং পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়: ২০২২-২৩ অর্থবছরে হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৩০ লাখ ৭ হাজার ৩৭৫ টিইইউস (ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি -৭.৬২%)।
২০২১-২২ অর্থবছরে ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৮ টিইইউস (প্রবৃদ্ধি ৫.১১%)।
২০২০-২১ অর্থবছরে ৩০ লাখ ৯৭ হাজার ২৩৬ টিইইউস (প্রবৃদ্ধি ৩.১০%)।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ লাখ ৪ হাজার ১৪২ টিইইউস (প্রবৃদ্ধি ২.৯২%)।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৯ লাখ ১৯ হাজার ২৩ টিইইউস (প্রবৃদ্ধি ৩.৯০%)।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৮ লাখ ৯ হাজার ৩৫৪ টিইইউস (প্রবৃদ্ধি ১২.১৭%)।
এদিকে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে খোলা বা বাল্ক পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে ১৩ কোটি ৭ লাখ ২৪ হাজার ৭৮৩ মেট্রিক টন, যা আগের বছরের তুলনায় ৬.০৭ শতাংশ বেশি। পাশাপাশি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে মোট জাহাজ এসেছে ৪ হাজার ৭৭টি, যা আগের বছরের ৩ হাজার ৯৭১টির তুলনায় বেশি। চট্টগ্রাম বন্দরের এই সাফল্য দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক বার্তা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।