শাহিনুর রহমান সুজন, চারঘাট রাজশাহী : কথা ছিল বর্ষা মৌসুমে পানি খালের মাধ্যমে নদীতে গিয়ে পড়বে, দূর হবে এলাকার জলাবদ্ধতা। আর শুষ্ক মৌসুমে সেই খালে পানি সংরক্ষণ করা হলে ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা বাড়বে, যা কৃষকদের জন্য সেচসুবিধা নিশ্চিত করবে। কিন্তু সেই ‘সেচসুবিধা সম্প্রসারণ প্রকল্প’ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিরাট আশাবাদকে সামনে রেখেই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-বিএমডিএ খাল খনন করেছিল। কিন্তু বাস্তব চিত্র ঠিক উল্টো। দুই-তিন বছর পার না হতেই সেই খালই তিন উপজেলার কৃষকদের জন্য গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। বর্ষায় জলাবদ্ধতায় বিপর্যস্ত হচ্ছেন তারা, আর শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানির অভাবে সেচ দিতে না পেরে হাহাকার করছেন। যে প্রকল্প একসময় আশার আলো দেখিয়েছিল, আজ সেটাই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পটির নাম দেয়া হয়েছে ‘রাজশাহী জেলার বাঘা, চারঘাট ও পবা উপজেলার জলাবদ্ধতা নিরসন এবং ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচসুবিধা সম্প্রসারণ’। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় বাঘা উপজেলার মুর্শিদপুর থেকে নওটিকা পর্যন্ত ৮ দশমিক ২০ কিলোমিটার, চারঘাট উপজেলার মেরামতপুর কাঁকড়ামারী বিল থেকে পিরোজপুর পদ্মা নদী পর্যন্ত ২ দশমিক ১০ কিলোমিটার ও চারঘাটের ইউসুফপুর পদ্মা নদী থেকে পবা উপজেলার কাঁটাখালি হয়ে ছত্রগাছি পর্যন্ত ১১ দশমিক ২০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়। ২০১৯ সালে ২৪ মে এই কাজের উদ্বোধন হয়ে খাল খনন কাজ শেষ হয়েছে ২০২১ সালের শেষের দিকে। খালের পাশে রোপণ করা হয় ৮ হাজার ফলজ ও বনজ চারা। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল জলবদ্ধতা দূর করে ও সেচ সুবিধা নিশ্চিত করে ১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমি ফসলাদি চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসা। এই প্রকল্পের আওতায় থাকা তিন উপজেলার খালপাড়ের কৃষকেরা বলছেন, স্থানীয় জনগণের মতামত ছাড়াই কোটি কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জনমত জরিপের তোয়াক্কা না করেই নেয়া এই সিদ্ধান্ত এখন তাদের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঘা ও চারঘাটের কৃষকেরা খাল খননের বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। বরং বাধা দেয়ায় তারা মামলা ও হামলার শিকার হয়েছেন। আজ সেই খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহিত হয় না, আর শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে-যদিও তাদের পাশেই খাল রয়েছে। তবে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ বলছেন, এলাকায় জরিপ করেই এই প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদনের আগে এলাকার মানুষ জলাবদ্ধতায় তাঁদের দুর্ভোগের কথা বলেছেন। তাঁদের দুর্ভোগ লাঘবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

সরেজমিনে চারঘাট উপজেলার মেরামতপুর, কাঁকড়ামারী বিল, পিরোজপুর-পদ্মা নদী খাল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পদ্মা নদীর অংশে খালের কোনো অস্তিত্ব নেই। সরু খাল খনন করে তার ওপরে পাটাতন দিয়ে পিচঢালা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এখন সেই খাল পরিণত হয়েছে ড্রেনের মতো সরু গর্তে, যেখানে ময়লা-আবর্জনা ও মাটির স্তুপ পড়ে এক বিন্দুও পানি প্রবাহের সুযোগ নেই। পিরোজপুর এলাকার কৃষক মামুন রানা জানান, তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কালভার্টের মুখে পুকুর খনন করে কাঁকড়ামারী বিলে জলাবদ্ধতা তৈরি করেছিল। পরে সেই জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বও দেয়া হয় তাদেরই। কিন্তু প্রকল্পের অর্থের সিংহভাগ লুটপাট হয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, আগে শুধু বিলে জলাবদ্ধতা থাকলেও খাল খননের পর বর্ষাকালে বসতবাড়িতেও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। অথচ খাল খননের সময় মাসখানেক আগে নির্মিত দেড় কোটি টাকার নতুন সড়কও ধ্বংস করা হয়েছে। ফলে উন্নয়নের নামে জনদুর্ভোগ আরো বেড়েছে।