খুলনার ৬ সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে নগরবাসী। এসব বাহিনীর আধিপত্য বিস্তার ও মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত নগরীতে হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে অর্ধশত ব্যক্তি। পুলিশের কার্যক্রম স্বাভাবিক না হওয়া এবং র্যাবের ঝিমিয়ে পড়া অভিযানের কারণে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ওই সব সন্ত্রাসী বাহিনী। প্রতি রাতে খুনোখুনির সংবাদে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যানুযায়ী, খুলনায় বর্তমানে ৬টি সন্ত্রাসী গ্রুপ আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রতিরাতে খুনোখুনিতে লিপ্ত রয়েছে। এই গ্রুপগুলো হলো গ্রেনেড বাবুর বি-কোম্পানি, চরমপন্থি হুমা বাহিনী, আশিক বাহিনী, পলাশ বাহিনী, নুর আজিম বাহিনী ও দৌলতপুর এলাকার আরমান বাহিনী। আরমান এবং নুর আজিম কারাগারে থাকলেও নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে সেখান থেকে।
একাধিক সূত্র জানায়, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাসে খুন হয়েছে অন্তত অর্ধশত মানুষ। মাসে শত কোটি টাকার মাদক বাণিজ্যে ও এলাকার প্রভাব বিস্তারের লড়াই খুলনায় রক্তাক্ত সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। এসব সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। ফলে গোটা খুলনাঞ্চলজুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক।
সূত্র জানায়, সর্বশেষ শুক্রবার রাতে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে নগরীর লবণচরা থানার মধ্য হরিণটানা এলাকার আজাদ মেম্বরের বাড়ির সামনে রাজু নামের একজনকে নুর আজিম ও গ্রেনেড বাবুর সদস্যরা হত্যার উদ্দেশ্যে পরপর ৬টি গুলি করে। ৪টি গুলি রাজুর পিঠে, একটি গলায় এবং একটি গুলি বুকের বাম পাশে বিদ্ধ হয়। রাতে গুলিবিদ্ধ ওই যুবককে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়। গত রোববার রাতে খুলনা নগরীর সোনাডাঙ্গা মডেল থানার করিমনগর এলাকায় বাসায় ঢুকে স্ত্রী’র সামনে গুলি করে ও জবাই করে হত্যা করা হয় আলাউদ্দিন মৃধা নামের এক মাদক বিক্রেতাকে।
সূত্রটি আরও জানায়, ৬টি সন্ত্রাসী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে খুলনায় মাসে অন্তত ৭০ থেকে ১০০ কোটি টাকার মাদক কেনা-বেচা হয়। মাদকের এই বিশাল বাজার নিয়ন্ত্রণ নিতে খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী রনি চৌধুরী ওরফে গ্রেনেড বাবু (বি-কোম্পানি), শেখ পলাশ, নুর আজিম, এবং আশিক বাহিনী প্রায়ই বিরোধে জড়ায়। এর মধ্যে মাদকের অর্ধেকের বেশি একাই নিয়ন্ত্রণ করে গ্রেনেড বাবু।
সূত্রটি জানায়, পাঁচ শতাধিক সদস্যের বাহিনী নিয়ে খুলনা ও আশে পাশের এলাকায় মাদকের সিন্ডিকেট পরিচালনা করে গ্রেনেড বাবু। আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ১২ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রস্তুত করে পুরস্কার ঘোষণা করলে বেশিরভাগ সন্ত্রাসী গ্রেফতার হলেও গ্রেনেড বাবু ও আশিক এখনও রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এছাড়া দৌলতপুর, খানজাহান আলী ও আড়ংঘাটা থানা এলাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণ করছে হুমা বাহিনী ও আরমান বাহিনী। আধিপত্য নিয়ে এই দুই গ্রুপের মধ্যে খুনো খুনি প্রায়ই ঘটে।
সূত্রটি আরও জানায়, খুলনার ওই ৬টি সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধানরা ৫ আগস্টের আগে খুলনার আলোচিত শেখ বাড়ির শেল্টারে ছিল। তবে ওই সময় ওদের মধ্যে সমঝোতা থাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম তুলনামূলক কম ছিল।
কেএমপি’র সহকারী পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া এন্ড সিপি) ত ম রোকনুজ্জামান বলেন, “মাদকের আধিপত্য বিস্তার নিয়েই প্রতিরাতে খুনখারাবির ঘটনা ঘটছে। বিগত সরকার পতনের পরপর পুলিশের নিস্ত্রীয়তায় ৬টি সন্ত্রাসী বাহিনীর তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। চোরাচালানের মাধ্যমে আসা মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এরা খুনখারাবি করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে।
র্যাব-৬ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল নিস্টার আহমেদ বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। নিয়মিত আসামি ধরে তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দিয়ে চালান দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক হত্যাকান্ডের পরিমাণ খুলনায় বেড়েছে তা তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। সম্প্রতি খুলনার সোনাডাঙ্গা মডেল থানার করিমনগর এলাকায় মাদকের অর্থ ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে যুবককে গুলী এবং জবাই করে হত্যা করা হয়। মামলার আসামী মিন্টু শেখকে রূপসা উপজেলার হোসেনপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। এ মামলার অন্যতম প্রধান আসামীকে গ্রেফতারের জন্য আইচগাতিতে অভিযান চালানো হলে সেখান থেকে সে পালিয়ে যায়। এ সকল হত্যাকান্ডের আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলমান আছে। তিনি আরও বলেন, খুন খারাবি একটি সামাজিক ব্যাধি এবং অপরাধ। এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সমাজের সকল স্তরের নাগরিককে এ ব্যাধি দূর করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
চরমপন্থী ও সন্ত্রাসী গ্রেফতার এবং অস্ত্র উদ্ধারে সেনা ক্যাম্প হচ্ছে : খুলনায় সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে চরমপন্থী, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ও মাদক সিন্ডিকেটের সদস্যদের গ্রেফতারে এ ক্যাম্প স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারেও প্রাধান্য দেওয়া হবে। প্রশাসনের একটি দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
৫ আগস্ট পরবর্তী দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলায় চরমপন্থীদের পুনরুত্থান হয়েছে। বেড়ে গেছে খুন-খারাবি। মাদকে পাড়া মহল্লা সয়লাব। প্রতিনিয়ত চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। প্রতিদিন ঘটছে কোনো না কোনো অঘটন। সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। গেল ১৫ মাসে খুলনা জেলা ও মহানগরে কমপক্ষে ৯৪ জন খুনের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে খুন হয়েছে কমপক্ষে অর্ধশত।
খুলনার আইন-শৃখলার চরম অবনতিতে সরকার বিব্রত। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশি তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি খুলনায় একটি আলাদা সেনা ক্যাম্প স্থাপন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে ক্যাম্প স্থাপনের জন্য জায়গা নির্ধারণের কাজ করছে প্রশাসন। যাতায়াতের সুবিধার জন্য মহাসড়ক সংলগ্ন জায়গা নির্ধারণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। রূপসা টোল প্লাজার আশপাশে এ ক্যাম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আগামী মাসের শুরু থেকে শতাধিক সদস্য নিয়ে ক্যাম্পের কার্যক্রম শুরু হতে পারে।
প্রাথমিকভাবে কিশোর গ্যাংদের চিহ্নিত করে তাদের কাছে থাকা অস্ত্র উদ্ধারে জোর দেওয়া হবে। মাদক সিন্ডিকেট গ্রেফতারের পাশাপাশি নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি এবং জনযুদ্ধের সদস্যদের গ্রেফতারে কাজ করবে এ সেনা সদস্যরা। যদিও এসব সংগঠনের সদস্যরা নানা নামে এবং নানা রূপে আবারও সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে। নির্বাচনের আগে আরও শতাধিক সদস্য ওই ক্যাম্পে মোতায়েন করা হতে পারে। ২০২৬ এর ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত রাখতে এবং খুলনার বর্তমান অবস্থা পরিবর্তনে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।