মোহাম্মদ নুরুজ্জামান, রংপুর অফিস : রংপুর বিভাগের চরাঞ্চলে মানুষের কর্মসংস্থান এবং পণ্য পরিবহনে ঘোড়ার গাড়ি এখন আর্শিবাদে পরিণত হয়েছে।
রংপুর বিভাগের বিভিন্ন চরাঞ্চলের পণ্য পরিবহনে এখন অন্যতম প্রধান বাহন হিসেবে ভূমিকা পালন করছে ‘ঘোড়ার গাড়ি’। এই ঘোড়ার গাড়ির ওপর নির্ভর করে চরাঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ছোট বড় ২৬৪ টি নদী রয়েছে। এসব নদী তীরবর্তী এলাকায় জনবসতি পূর্ণ প্রায় ৬শতাধিক প্রধান চরে ৩২ জাতের বিভিন্ন ফসল উৎপন্ন করা হয় ।
জানা গেছে, রংপুর বিভাগের দিনাজপুর, ঠাকুরগাও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা, করোতয়া ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার, ফুলকুমার সহ ২৬৪ টি ছোট বড় নদ-নদীর বুকে রয়েছে প্রায় ৫৬২টি বিভিন্ন জনসংখার চর। প্রত্যেক চরে রয়েছে ১০ থেকে ৫০টি ঘোড়ার গাড়ি। এক যুগ আগেও রংপুর অঞ্চলের চর এবং পল্লী এলাকায় মহিষের গাড়িতে পণ্য পরিবহন চোখে পড়তো। এখন আর তেমন মহিষের গাড়ি চোখে পড়ে না।
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে শাখাহাতি চরাঞ্চল এলাকার ঘোড়ার গাড়ি চালক রাজু ইসলাম জানান, তারা একটি ঘোড়া ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় কিনেন। একটি ঘোড়ার গাড়ি প্রস্তুত করতে খরচ হয় ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। ঘোড়ার গাড়িতে পণ্য পরিবহন করতে তাদেরকেও ঘোড়ার মতোই পরিশ্রম করতে হয়। প্রত্যেক গাড়িতে ১০ থেকে ১৫ মণ পণ্য পরিবহন করা যায়। ৩-৪ কিলোমিটার দুরত্বের বালুচরে প্রতি মণ পণ্য পরিবহন করতে ৮০ থেকে ১০০ টাকা ব্যয় হয়। ঘোড়ার গাড়ি না থাকলে চরাঞ্চলে পণ্য আনা-নেয়া করা তাদের দুষ্কর হতো। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদেরবুকের চর জোরগাছ এলাকার ঘোড়ার গাড়ি চালক ইসলাম (৪৮) বলেন, তিনি ঘোড়ার গাড়িতে পণ্য পরিবহন করে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় করেন। ঘোড়ার খাদ্য বাবদ খরচ হয় ৫ থেকে ৬’শ টাকা। প্রতিটি চরে ১০ থেকে ৫০টি ঘোড়ার গাড়ি রয়েছে। তারা ঘোড়া গাড়ি দিয়ে মূল ভূখন্ড থেকে চরে পণ্য পরিবহন করেন। ঘোড়ার সাথে তাদেরকেও বালুচরে হাঁটতে হয়।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদেরবুকে চর যাত্রাপুর এলাকার ঘোড়ার গাড়ি চালক শফিকুল ইসলাম (৫৫) বলেন, পণ্য পরিবহনে অন্য কোন যানবাহন না থাকায় চরাঞ্চলের উৎপন্ন ফসল মানুষ নিজেই পরিবহন করে মূল ভূখন্ডে নিয়ে আসে। এছাড়া সরকারী অফিস এবং এনজিও কর্মীরা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে তাদের দায়িত্ব পালনে গন্তব্যে পৌঁছান। বছরের প্রায় আটমাস শুকনো মৌসুমে ঘোড়ার গাড়িই চরের জনজীবনে প্রাণ ফিরে আনে। বর্ষাকালে ঘোড় গাড়ির ব্যবহার কমে যায়। লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা নদীরবুকে জেগে ওঠা কালমাটির চর এলাকার ঘোড়া গাড়ি চালক মেহের আলী (৪৮) বলেন, চরাঞ্চলে শত শত পরিবারের জীবিন জীবিকা নির্ভর করছে ঘোড়ার গাড়ির ওপর। বর্ষাকালে নৌকায় পণ্য ও যানবাহন পারাপার হয়। তবে শুকনো মৌসুমে যাত্রীরা পায়ে হেঁটে চলাচল করেন। পন্য পরিবহন করেন ঘোড়ার গাড়িতে। চরের জন্য বিশেষ কোন বাহন আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত ঘোড়ার গাড়িই থাকবে চরের অন্যতম বাহন হিসেবে।
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার তিস্তারবুকে চর গোবর্ধান এলাকার কৃষক ফজলার রহমান (৬৫) বলেন, তারা চরের জমিতে উৎপন্ন ফসল ঘোড়ার গাড়িতে বহন করে মূল ভূখন্ডে নিয়ে যান। ঘোড়ার গাড়ি না থাকলে তাদের পক্ষে এসব পণ্য বহন করে বালুর ওপর দিয়ে চলা অসম্ভব ছিলো। শু কনো মৌসুমে ঘোড়ার গাড়ি চরের জনজীবনকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করছে। তবে বর্ষাকালে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার হয় না। দুই যুগ আগেও চরে তেমন ঘোড়ার গাড়ি ছিলো না, তখন ছিলে মহিষের ও গরুর গাড়ি। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর হাটের ব্যবসায়ী কবির হোসেন বলেন, তারা ঘোড়ার গাড়িতে পণ্য পরিবহন করে হাট-বাজারে বিক্রি করেন। চর অঞ্চল থেকে পণ্য কিনে তা ঘোড়ার গাড়িতে পরিবহন করে মূল ভূখন্ডে নিয়ে আসেন। ঘোড়ার খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের চেয়ে ঘোড়ার গাড়িতে পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়েছে। ‘চরের অর্থনীতি এখন সমপূর্ণ ঘোড়ার গাড়ির ওপর নির্ভরশীল। চরে আমাদের ব্যবসা টিকে থাকছে গোড় গাড়ির জন্য।
এসব জেলার বিভিন্ন চররে ভুক্তভুগিরা বলেন, শুকনো মৌসুমে নদ-নদীতে পানির নাব্যতা কমে যাওয়ায় মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে নৌকা চলাচল করতে পারে না। এসময় বালুচরে পণ্য পরিবহনে একমাত্র বাহন হয়ে ওঠে ঘোড়ার গাড়ি। ‘বর্তমানে ঘোড়ার গাড়িকে বাদ দিয়ে চরের অর্থনীতি চিন্তা করা যায় না। চরাঞ্চলের মানুষের জীবন দুর্বিষহ। চর ও চরের মানুষের তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। ‘চরাঞ্চলের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় হলে চরের উন্নয়ন হবে।
রংপুর পরমানু কৃষি বিজ্ঞানি বিনা কর্মকর্তা কৃষিবিদ ডক্টর মোহাম্মল আলী জানান, রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ৯১ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ফসল চাষ হয়। এতে ৫৬২ টি চরে গোল আলু, বাদাম, মিষ্টি আলু, মিষ্টি কুমরা, ভুট্টা সহ ৩২ জাতের ফসল উৎপন্ন হয়। ঘোড়ার গাড়ি না থাকলে চরাঞ্চলে পণ্য আনা-নেওয়া করা সম্ভব হতো না। দুর্গম চরে ঘোড়া গাড়িতে যাতায়াতে ফলে ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন চাষিরা। ঘোড়ার গাড়িতে পণ্য পরিবহনে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়ে চরাঞ্চলের মানুষের আর্শিবাদে পরিণত হয়েছে।