রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড (বর্তমানে আভিভা ফাইন্যান্স লিমিটেড) থেকে প্রায় ২৭০ কোটি টাকার অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে তিনটি পৃথক মামলা দায়েরের অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল বুধবার তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়।

রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মহাপরিচালক আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করে তা আত্মসাৎ এবং পরবর্তী সময়ে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থানান্তর করেছেন।

দুদক সূত্র জানায়, প্রথম মামলায় অভিযোগ করা হয়, ৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয় মেসার্স মোস্তফা অ্যান্ড কোংয়ের নামে। পরে এই অর্থ মেরিন ভেজিটেবল অয়েলস লিমিটেড ও এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেডের বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। দ্বিতীয় মামলার অভিযোগে বলা হয়, মেসার্স এ এম ট্রেডিংয়ের নামে ১০৪ কোটি ২০ লাখ ৭৭ হাজার টাকার ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করা হয়। এরপর অর্থটি জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ঘুরিয়ে শেষ পর্যন্ত এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেডের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। তৃতীয় মামলায় মেসার্স সাইফুল অ্যান্ড কোংয়ের নামে ৭১ কোটি ৫১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একই প্রক্রিয়ায় এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেডে স্থানান্তর করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

মামলার বাকি আসামিরা হলেন এস আলম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ (৫৯), পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ হাসান (৪৯), পরিচালক শাহানা ফেরদৌস (৪৯), রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ইভিপি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান রাশেদুল হক (৫৪), ম্যানেজার ও করপোরেট ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান নাহিদা রুনাই (৪৪), এসভিপি ও মেম্বার, ক্রেডিট কমিটির কাজী আহমেদ জামাল (৫৯), সাবেক ডেপুটি ম্যানেজার, করপোরেট ফাইন্যান্স জুমারাতুল বান্না (৩৯), মেরিন ভেজিটেবল অয়েলস লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির আহমেদ (৫১), পরিচালক টিপু সুলতান (৪৪), পরিচালক মো. ইসহাক (৬৯), মেসার্স মোস্তফা অ্যান্ড কোংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. গোলাম মোস্তাফা (৬০) ও মেসার্স এ এম ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুল্লাহ আল মামুন (৪২) এবং মেসার্স সাইফুল অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম। তাঁদের মধ্যে প্রথম ১২ জনকে ৩টি মামলাতেই আসামি করা হয়েছে।

দুদকের অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামিরা প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ঋণ গ্রহণের পর তা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ঘুরিয়ে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করেন। এর মাধ্যমে একদিকে রাষ্ট্রের অর্থ লোপাট করা হয়েছে, অন্যদিকে মানি লন্ডারিং আইন লঙ্ঘন হয়েছে।

তলবে হাজির হননি বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান : জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হলেও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) যাননি তিনি। গতকাল বুধবার তাঁকে দুদকে তলব করা হয়েছিল।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির মহাপরিচালক আক্তার হোসেন দুপুরে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের বক্তব্য জানতে অনুসন্ধান কর্মকর্তা তাঁকে ডেকেছিলেন। কিন্তু তিনি এসেছিলেন কি না, সেটা তাঁর জানা নেই। তবে দুদকের একটি সূত্র জানিয়েছে, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান গতকাল দুদকে যাননি।

দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, নিয়ম অনুযায়ী যাঁর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে, তাঁর বক্তব্য জানতে তলব করা হয়। যদি তিনি না আসেন, তাহলে ধরে নেওয়া হয় তাঁর কোনো বক্তব্য নেই।

গত ৩০ জুন দুদকের এক নোটিশে অভিযোগসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরার জন্য বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানকে গতকাল সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত থাকতে বলা হয়।

ভূমি জবরদখল, অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের গত মে মাসেও তলব করেছিল দুদক। দুদক থেকে পাঠানো নোটিশে সেই মাসের ২৫ ও ২৬ তারিখ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁদের সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছিল। নোটিশে বলা হয়, আহমেদ আকবর সোবহান (শাহ আলম), তাঁর পরিবারবর্গ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ‘সরকারের রাজস্ব ফাঁকি, ভূমি জবরদখল, ঋণের অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ স্থানান্তর ও হস্তান্তরসহ মানি লন্ডারিং’-এর অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাঁদের বক্তব্য গ্রহণ করা হবে।

নোটিশ অনুযায়ী, আহমেদ আকবর সোবহান, তাঁর স্ত্রী আফরোজা বেগম, বড় ছেলে ও কো-চেয়ারম্যান সাদাত সোবহান এবং সাদাতের স্ত্রী সোনিয়া ফেরদৌসী সোবহানকে ২৫ মে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়। ২৬ মে ডাকা হয় আহমেদ আকবর সোবহানের ছেলে ও বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর, তাঁর স্ত্রী ও গ্রুপের পরিচালক সাবরিনা সোবহান, ভাইস চেয়ারম্যান সাফিয়াত সোবহান (সানভীর), ভাইস চেয়ারম্যান সাফওয়ান সোবহান ও তাঁর স্ত্রী এবং গ্রুপের পরিচালক ইয়াশা সোবহানকে। ওই সময়েও আহমেদ আকবর সোবহান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের কেউ দুদকে হাজির হননি।