কক্সবাজার দক্ষিণ সংবাদদাতা: কাক্সিক্ষত চাঁদা না পেয়ে চোরাচালানের গরু আখ্যা দিয়ে খামারির ১১টি গরু জব্দ এবং পরবর্তীতে জব্দকৃত ওই গরু থানায় নেওয়ার কাজে কৌশলে ৯ শিশুকে গরুটানার কাজে ব্যবহার করে পুলিশ। কথা ছিলো- বিনিময়ে মজুরি হিসেবে দেওয়া হবে জনপ্রতি তিন হাজার টাকা করে। কিন্তু কাজ শেষে মজুরি না দিয়ে উল্টো চোরাচালান মামলা দিয়ে কোর্টে চালান করে দেয় ওই শিশুদের। এদের মধ্যে সর্বনিম্ন ১২ বছর বয়সী শিশুও রয়েছে। পরে আদালত এসব শিশুদের জামিন দিলেও পুলিশের এহেন কান্ডে বিব্রত এলাকাবাসী। সেই সাথে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে সচেতন মহলে। ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সীমান্তজেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থানায়।
ভুক্তভোগী ওই ৯ শিশু হলেন- মৃত নুরুল হাকিমের পুত্র মো. ইলিয়াস (১২), মৃত আব্দুর রহিমের পুত্র মো. আরিফ (১৬), মো. কালুর পুত্র রহিম উল্লাহ (১৫), মো. হাশেমের পুত্র ইমাম হোসেন (১৬), মোজাফ্ফরের পুত্র মো. আনোয়ার (১৪), মৃত হোসেন আহমদের দুই পুত্র মো. আয়াস (১৫) ও মো. মনসুর আলম (১৪), নুর হোসেনের পুত্র আবু সুফিয়ান (১৬) এবং মো. আমান উল্লাহর পুত্র মো. সেলিম (১৬)। এরা প্রত্যেকেই নাইক্ষ্যংছড়ির সাথে লাগোয়া পাশ্ববর্তী জেলা কক্সবাজারের রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা।
জামিনে এসে এসব শিশুরা অভিভাবকসহ সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। তারা অভিযোগ করে জানান- ঘটনার দিন দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা চাহিদা মতো চাঁদা না পাওয়ায় স্থানীয় খামার থেকে কিছু গরু জব্দ করেন। যা পরিবহণ করে থানায় নেওয়ার জন্য কোন বাহন না পেয়ে আমাদের কয়েকজনকে ডেকে গরুগুলো থানায় পৌঁছে দিতে বলেন পুলিশ। বিনিময়ে পুলিশ আমাদের জনপ্রতি তিন হাজার টাকা এবং ভালো খাবার খেতে দিবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু ওই গরু কষ্ট করে টেনে থানায় পৌঁছে দেওয়ার পর পুলিশ উল্টো আমাদের আসামী সাজিয়ে চালান করেন দেন আদালতে।
অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা হলেন- নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাসরুরুল হক, এসআই অর্ণব কান্তি সানা, ওইদিন টহলরত পুলিশ সদস্য রাসেল নাথ, অনুপ বড়ুয়া, মোহাম্মদ ইব্রাহিম, মিল্টন বড়ুয়া, নাজমুল হক, ফারুক হোসেন, আজগর হোসাইন, সাইফুল ইসলাম, ড্রাইভার সানি দাশ, নুরুল করিম এবং আব্দুল্লাহ আল মামুন।
ভুক্তভোগী শিশু মো. ইলিয়াস (১২) জানান- গত ২৬ ফেব্রুয়ারি নাইক্ষ্যংছড়ি থানা পুলিশ ১১টি গরু জব্দ করে। জব্দকৃত গরু থানায় পৌঁছে দিলে নগদ অর্থ ও ভালো খাবার দেওয়া হবে এমন প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে থানায় নেয়া হয়। তারপর ওই গরুর চোরাচালান মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আমাকে সহ আরও ৯ শিশুকে আদালতে সোপর্দ করেছে নাইক্ষ্যংছড়ি থানা পুলিশ। পরে বিজ্ঞ বিচারক আমাদের দেখার সঙ্গে সঙ্গে জামিন মঞ্জুর করেছেন।
কান্নাজড়িত কন্ঠে ১২ বছর বয়সী মো. ইলিয়াছ আরও জানায়, 'দোকানের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ কিছু গরু আটকালো পুলিশ। সেগুলো থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক খুঁজতেছিল। তখন আলমগীর (দালাল) নামে একজন ও পুলিশের কয়েকজন আমাদের খরচের টাকা ও ভাল করে খাবার খাওয়াবেন বলে গরুগুলো থানায় পৌঁছে দিতে বলেন। তখন আমরা গরুগুলো নিয়ে থানায় যাই। খাবারও দেওয়া হয়। কিন্তু এরপর আর বাড়ি ফিরতে দেয়নি। খাবার দেওয়ার পর আমাদের একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখে। পরের দিন পুলিশের গাড়িতে করে আমাদের বান্দরবানে চালান করে দেয়।
শিশু মনসুর আলমের মা নুর জাহান বেগম দাবি করেন- গরুচোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যদের বাদ দিতেই শিশুদের আসামী করেছে পুলিশ। তাই তাদের প্রলোভন দিয়ে ফুলতলা মাঝিরছড়া বাজারের সামনে থেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
একই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে জহুরা এগ্রো ফার্মের মালিক জামশেদকে। তিনি বলেন- জব্দকৃত গরুগুলোর বাজার থেকে কিনেছেন কালু নামে এক ব্যবসায়ী। যার রশিদও রয়েছে। তারপরও ওসি আমাকে এ মামলায় ১২ নাম্বার আসামী করেছেন। বিভিন্নভাবে হুমকিও দিচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন- এর আগে নাইক্ষ্যংছড়ি থানা পুলিশের ওসি মাসরুরুল হক আমাকে থানায় ডেকে নিয়ে একান্তে বিভিন্ন অনৈতিক কথাবার্তা বলেন। বান্দরবানের এসপিকে এককালীন ৪০ লাখ টাকা দিয়ে এথানায় এসেছেন এবং প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা করে এসপিকে দিতে হয় বলে দাবি করেন। এ মোতাবেক আমাকে গরুপ্রতি ১হাজার টাকা করে চাঁদা দাবি করেন। এই টাকা উত্তোলন করতে ওসি তার ক্যাশিয়ার আলমগীরকে মোকাবেলা করে দেন। কিন্তু আমি গরু প্রতি শুরু থেকেই ৫শ’ টাকা করে দিয়ে এসেছি। সর্বশেষ ওসি সাহেবের জন্য আলমগীরের হাতে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা দিই। কিন্তু গরু প্রতি ১ হাজার টাকা করে না দেওয়ায় গরু চোরাচালান মামলায় আমাকে আসামী করা হয়েছে। যার যাবতীয় ডিজিটাল প্রমাণ আমার হাতে রয়েছে।
এদিকে নাইক্ষংছড়ি থানার ওসি মাসরুরুল হকের ক্যাশিয়ার আলমগীর সর্বশেষ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে জামশেদের অধীনে ৬৩৪ টি গরু প্রবেশ করেছে দাবি করে একটি স্লিপ ধরিয়ে দেন কালুর হাতে। পরে ওই স্লিপ মোতাবেক গরু প্রতি ১হাজার টাকা করে ওসির জন্য চাঁদা দিতে চাপ দিতে থাকেন। দাবিকৃত ওই চাঁদা না দেওয়ায় ওসি মাসরুরুল হক টহল পুলিশ পাঠিয়ে কালুর বাড়ির খামার থেকে ১১টি গরু জব্দ করে নিয়ে আসেন। এবং ওই মামলায় জামশেদকেও চোরাচালানের অভিযোগে নাম নথিভুক্ত করেন।
অভিযোগ উঠেছে, এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছেন থানা ক্যাশিয়ার-সোর্স হিসেবে পরিচিত যুবদল নেতা মোহাম্মদ আলমগীর। তবে, শিশুদের ফাঁসানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি মাসরুরুল হক। তিনি দাবি করেন, এসব কিছু তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
ওসি মাসরুরুল হকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এবারই প্রথম নয়। চোরাচালানে আসা গরু থেকে চাঁদা আদায়সহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বান্দরবান জেলার পুলিশ সুপার শহিদুল্লাহ কাউসারের সাথে বিস্তারিত কথা হয় প্রতিবেদকের সাথে। তিনি বলেন, ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও যে শিশুদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের শিশু আইন অনুযায়ী আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে এবং স্পেশাল অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে।