# এএসপি নিয়োগে লাগবে আলাদাভাবে শারীরিক যোগ্যতা
# জেলার এসপি ও থানার ওসি নিয়োগে হবে ফিটলিষ্ট
# বিশেষায়িত পুলিশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হবে পদায়ন
# কনস্টেবল থেকে এএসআই ও এএসআই থেকে এসআই পদোন্নতি পরীক্ষা একবার
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুলিশে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে দলীয় বিবেচনাই ছিল বড় যোগ্যতার মাপকাঠি যে কারণে গোটা বাহিনীর চিত্র পাল্টে যায়, পরিনত হয় দলীয় বাহিনীতে। কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যর দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিসহ অপেশাদার আচরণের কারনে বাহিনীটির ওপর লেগে যায় কলঙ্ক তিলক। দলীয় ও ঠেঙ্গারে বাহিনীতে পরিণত করে সুবিধাবাদীরা হয়ে ওঠেন দেশের আইনশৃংখলার রক্ষাকর্তা। তারা বেআইনিভাবে আটক, গ্রেফতার, তুলে নিয়ে অস্বীকার করা, যতদিন খুশি আটক ও গুম করে রাখার মতো ঘটনায় বাধাহীনভাবে জড়িয়ে পড়েন। দেশজুড়ে ভীতির সংস্কৃতি চালু করেন। এই সংস্কৃতির অবসান চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরই অংশ হিসেবে পুলিশ বাহিনীর নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ বাংলাদেশ পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সূত্র মতে, গত ১৯ জুন সাত সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে জননিরাপত্তা বিভাগ। এই কমিটির সভাপতি করা হয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ( পুলিশ ও এনটিএমসি অনুবিভাগ) কে। জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-১ অধিশাখার যুগ্ম সচিবকে করা হয়েছে কমিটির সদস্য সচিব। এই কমিটিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এর একজন প্রতিনিধি (যুগ্মসচিব পদমর্যাদা সম্পন্ন), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি (যুগ্মসচিব পদমর্যাদা সম্পন্ন), জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-২ অধিশাখার যুগ্ম সচিব, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রতিনিধি (যুগ্মসচিব পদমর্যাদা সম্পন্ন) এবং পুলিশ সদর দপ্তরের একজন প্রতিনিধি (ডিআইজি পদমর্যাদা সম্পন্ন) রয়েছেন। কমিটি প্রয়োজনে এক বা একাধিক সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবেন বলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের পত্রে উল্লেখ করা হয়। পত্রটি সংস্কার অগ্রাধিকার দিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে জারী করা হয়।
কমিটির কার্যপরিধিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) নিয়োগের ক্ষেত্রে যে ধরনের শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতার প্রয়োজন, তা উপেক্ষিত হচ্ছে। এজন্য বর্তমান বিসিএস পরীক্ষায় পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগের জন্য আলাদাভাবে শারীরিক যোগ্যতা (উচ্চতা ও ওজন ইত্যাদি পরিমাপ, ফিজিক্যাল এনডিউরেন্স টেস্ট (পিইটি), মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ইত্যাদি) অন্তর্ভুক্ত করে আবেদনের যোগ্যতা নিরূপণ করা যায়। এতে, আগ্রহী এবং যোগ্য প্রার্থীরা পুলিশ ক্যাডারে আবেদন করার জন্য সহজে বিবেচিত হতে পারবেন। এক্ষেত্রে ঞযব ইধহমষধফবংয ঈরারষ ঝবৎারপব (ঊহভড়ৎপবসবহঃ: চড়ষরপব) ঈড়সঢ়ড়ংরঃরড়হ ধহফ ঈধফৎব জঁষবং, ১৯৮০সহ সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনয়নের সুপারিশের বিষয়ে মতামত প্রদান করা হয়।
পুলিশ সার্ভিসের পুলিশ সুপার, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদায়নের জন্য ফিটলিস্ট প্রস্তুত করে নিয়মিত বিরতিতে হালনাগাদ করা। হালনাগাদকৃত তালিকা থেকে পুলিশ সুপার ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদায়নের সুপারিশের বিষয়ে মতামত প্রদান করা হবে।
বিশেষায়িত পুলিশ যথা (সিআইডি, সাইবার অপরাধ, বায়োমেট্রিক আইডেনটিফিকেশন ফিঙ্গারপ্রিন্ট ইত্যাদি) স্ব-স্ব বিভাগের ভেতরে বা সংশ্লিষ্ট পদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদায়নের সুপারিশের বিষয়ে মতামত প্রদান, কনস্টেবল থেকে এএসআই এবং এএসআই থেকে এসআই পদোন্নতিতে প্রতি বছর পরীক্ষা দেওয়া ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার রীতি বাতিল করে ১ বার উত্তীর্ণ হলে তাকে শারীরিক যোগ্যতাসাপেক্ষে পরবর্তী তিন বছরের জন্য পদোন্নতির যোগ্য হিসেবে বিবেচনার করার সুপারিশের বিষয়ে মতামত প্রদান, পদোন্নতি নীতিমালা সংস্কার করে কনস্টেবল/এসআই নিয়োগ স্তর থেকে ক্যারিয়ার প্লান তৈরির বিষয়ে মতামত প্রদান, বর্তমানে থানাসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নারী পুলিশের সংখ্যা শতকরা মাত্র ৮ শতাংশ যা খুবই অপ্রতুল, থানাসহ ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার, সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন এবং অন্যান্য ইউনিটের অফিসে কাক্সিক্ষত নারী পুলিশের সংখ্যা বর্তমানে ১৬ হাজার ৮০১ থেকে বাড়িয়ে ২৯ হাজার ২৪৮ জনে উন্নীত করার সুপারিশ প্রদান করতে বিশেষজ্ঞ কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বর্তমান অর্গানোগ্রামে পদ সৃষ্টির জন্য সুপারিশ প্রদান করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, বিষয়গুলো আন্ত:মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত হওয়ায় আলোচনার জন্য বাস্তবায়নযোগ্য সময় নির্ধারণ করা হবে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পুলিশে দুই স্তরে এএসআই ও এএসপি পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর কাঠামোগত দক্ষতা বৃদ্ধির স্বার্থে নিয়োগ ও ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা এবং প্রশিক্ষণ হবে বিবেচনার মূল ভিত্তি। এ বিষয়ে বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে তিনি জানান।
পুলিশ সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশে পদায়ন, বদলি, পদোন্নতির ক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠাকে গুরুত্ব প্রদান নিশ্চিত করতে সুপারিশ করে। সুপারিশে আরও বলা হয়, নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা কর্মচারীর সততা ও নৈতিকতার উচ্চমান নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার পর তাঁদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা দরকার। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে উচ্চপর্যায়ের একটি পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে সম্পন্ন করা যেতে পারে। যেকোনো ধরনের অনিয়ম বা ব্যত্যয় হলে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। পদায়ন, বদলি ও পদোন্নতির জন্য ভিন্ন ভিন্ন স্তরে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করতে হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসক (ডিসি) হওয়ার জন্য প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পরীক্ষা দিয়ে ডিসি ফিটলিস্টে অন্তর্ভুক্ত হতে হয়। কিন্তু এসপি হতে এ রকম কোনো নিয়ম বা নীতিমালা ছিল না। ২০১৯ সালে পুলিশ সুপার (এসপি) পদে পদায়নে ডিসিদের মতো পুলিশ সুপারদেরও ফিটলিস্ট নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নীতিমালার খসড়াও প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু দলকানা পুলিশ কর্মকর্তা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের অনাগ্রহের কারণেই শেষ পর্যন্ত পর্যন্ত ওই নীতিমালা জারি করেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ফলে জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়নে দলীয় বিবেচনা, তদবির আর অর্থ বাণিজ্যই ছিল অন্যতম যোগ্যতা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ধরনের কর্মকা-ের লাগাম টানতে চায়। এরই অংশ হিসেবে এসপিদের ফিটলিষ্ট নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ
ড. তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশ সংস্কারের অংশ হিসেবে এসপি ও ওসি পদায়নে ফিটলিষ্ট করার উ্েযাগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কোন সরকারের হস্তক্ষেপ নয়, পুলিশকেই এই ফিটলিষ্ট করার দায়িত্ব দিতে হবে। এছাড়া পুলিশকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে। যাতে তারা ফিটলিষ্টের ভিত্তিতে প্রশিক্ষিত, যোগ্য, দক্ষ এবং বিতর্কমুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে এসপি বা ওসি হিসেবে পদায়ন করতে পারে। এছাড়া এই উদ্যোগের টেকসই রুপ দিতে হবে। তাহলে জনগণ যেমন তারে কাছ থেকে কাক্সিক্ষত সেবা পাবে, তেমনি জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে এ উদ্যোগ ফলপ্রসূ অবদান রাখতে পারবে।