সুন্দরবনে মাছ আহরণে টানা তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেও প্রতিশ্রুত সরকারি খাদ্য সহায়তা পাননি জেলে ও বনজীবীরা। ফলে নিষেধাজ্ঞার সময়ে তাদের পরিবারে দেখা দিয়েছে চরম খাদ্যসংকট। অনেকেই ছিলেন আর্থিক সংকটে, কেউবা খেয়ে না খেয়ে দিন পার করেছেন। জীবিকা বন্ধ থাকায় তিন মাস তাদের জীবন কেটেছে মানবেতর কষ্টে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় সমন্বিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার (আইআরএমপি) সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সাল থেকে প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দুই মাস মাছ ধরা বন্ধ থাকতো। ২০২২ সালে মৎস্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানো হয়। সেই থেকে ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ রাখা হচ্ছে। এই সময়ে নদী-খালে মাছের প্রজনন ঘটে, অধিকাংশ মাছ ডিম ছাড়ে। একই সঙ্গে বন্যপ্রাণীরও প্রজননকাল হওয়ায় পর্যটক ও জেলে না গেলে বনের জীববৈচিত্র্য নিরাপদ থাকে।

কিন্তু এ বছর নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেও সরকারি চাল সহায়তা পাননি বাগেরহাট, মোংলা, খুলনা ও সাতক্ষীরা উপকূলের হাজারো জেলে। স্থানীয় সূত্র জানায়, নিষেধাজ্ঞা জারি হলে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জসহ অন্যান্য অঞ্চলের জেলেরা কর্মহীন হয়ে পড়েন। প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই সমুদ্রে মাছ ধরা বন্ধ থাকে এবং সে সময় সমুদ্রগামী জেলেদের সরকারিভাবে ৮০ কেজি চাল দেওয়া হয়। কিন্তু সুন্দরবননির্ভর জেলেদের জন্য কোনো কার্যকর সহায়তা না থাকায় তারা প্রতি বছরই চরম দুর্ভোগে পড়েন।

মোংলার জেলেরা জানান, চলতি বছর তিন মাসের নিষেধাজ্ঞায় তাদের প্রত্যেককে ১২০ কেজি করে চাল দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা শেষে কোনো সহায়তা তারা পাননি। এতে অনেক পরিবারে তিন মাস ধরে একবেলা খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন সংসার চালাতে। জেলে বিদ্যুৎ মন্ডল বলেন, “তিন মাসের নিষেধাজ্ঞার সময়ে পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল সরকার। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেও কোনো চাল পাইনি। পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে কষ্টে দিন কাটাতে হয়েছে।” একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন বাগেরহাটের শরণখোলার জেলে মহিদুল খাঁ ও লিটন হাওলাদার। লিটন বলেন, “নিষেধাজ্ঞার আগে স্থানীয় মৎস্য অফিস থেকে আমাদের নাম নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুরো তিন মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো সহায়তা পাইনি। শেষ পর্যন্ত এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয়েছে সংসার চালাতে।” মহিদুল জানান, তিনি বাধ্য হয়ে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন এবং এখনও সরকারি চাল সহায়তা পাননি। কবে পাবেন তাও জানেন না।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের শেষ দিকে সুন্দরবনগামী প্রায় ১৮ হাজার ৪০০ জেলের তালিকা তৈরি করে মৎস্য অধিদফতরে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, তারা পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাননি। এ কারণে খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। খুলনা মৎস্য অধিদফতরের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. মনিরুল মামুন বলেন, “এখানে সমুদ্রগামী ও বনজীবী দুই ধরনের জেলে আছেন। বনজীবীদের আলাদা তালিকা চেয়েছিলাম। কিন্তু বন বিভাগ সঠিক সময়ে তালিকা না দেওয়ায় হালনাগাদ করা সম্ভব হয়নি, তাই সহায়তা দেওয়া যায়নি।” অন্যদিকে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, “আমরা ১৮ হাজার ৪০০ জেলের তালিকা তৈরি করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি এবং মৎস্য অধিদফতরের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তালিকা চূড়ান্ত না হওয়ায় এ বছর সহায়তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। আগামী বছর যাতে জেলেরা সহায়তা পান, সে বিষয়ে এখন থেকেই আলোচনা চলছে।”

স্থানীয় নাগরিক সংগঠনগুলো এ পরিস্থিতির জন্য প্রশাসনিক জটিলতা ও কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকে দায়ী করছে। ‘সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’ সংগঠনের সমন্বয়কারী মো. নুর আলম শেখ বলেন, “বন বিভাগ ও মৎস্য বিভাগের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেই জেলেরা সহায়তা পাননি। তারা দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করেছেন। এর ফলে তিন মাস জেলেদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়েছে। ভবিষ্যতে একই ঘটনা ঘটলে আমরা আন্দোলনে নামবো।”

বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ রাখা জরুরি হলেও জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা এখনো কার্যকর হয়নি। সরকারি বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও জেলেরা এ বছর সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন প্রশাসনিক জটিলতার কারণে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, প্রকৃতি রক্ষার পাশাপাশি জীবিকার নিশ্চয়তা কবে নিশ্চিত হবে।