কালাই (জয়পুরহাট) সংবাদদাতা : জয়পুরহাটের কালাইয়ের পাচশিরা বাজারে আজ ১৮ নভেম্বর মঙ্গলবার আগ্রাহায়ন মাস শুরু হয়েছে গ্রামঞ্চলে সনাতন ধর্মের প্রানের নবান্ন উৎসব। কৃষকদের ঘরে উঠেছে নতুন ধান। পিঠা-পায়েসের সাথে নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে কৃষকের কাঙ্খিত নবান্ন উৎসব। এ উৎসবকে ঘিরে মেয়ে-জামাই ও স্বজনদের নিয়ে জয়পুরহাটের কালাই পৌরশহরের পাঁচশিরা বাজারে বসেছে ১ দিনের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। ভোর ৪টা থেকে দিনব্যাপী চলে মাছ কেনা-বেচার উৎসব। এই দিনের অপেক্ষার প্রহর গুনেন এ জেলার প্রত্যক গ্রামের লোকজন। আর মেলায় ভিড় জমিয়েছেন জামাই ছাড়াও সব বয়সী মানুষ। সরকারি ক্যালেন্ডার নয়, পুঁথিগত প্রথা পঞ্জিকা অনুসারে অগ্রাহয়ণ মাসের প্রথমদিনে পাঁচশিরা বাজারে প্রতিবছর বসে বৃহৎ এ মাছের মেলা।

ভোরের কুয়াশা ভেদ করে পুর্ব আকাশে উকি দিচ্ছে সুর্যের আলো। সেই সাথে বইছে হিমেল বাতাস। শীত উপেক্ষা করে ভোর রাত থেকেই মেলা জুড়ে ছিল জামাইসহ ক্রেতা-বিক্রেতা আর কৌতুহলী মানুষের ঢল। বহু বছর পূর্ব থেকে পাঁচশিরা বাজারে নবান্ন উৎসবকে ঘিরে চলে আসছে এই মাছের মেলা। নদী, দীঘি ও পুকুরের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা দেশীয় প্রজাতির টাটকা মাছে ভরপুর ছিল এই মেলা। রীতি নয়, প্রথা অনুযায়ী প্রতি বছর নবান্ন উৎসব পালন করতে আসেন সারাদেশে বসবাসরত তাদের জামায়-মেয়ে, বিয়াই-বিয়ানসহ নিকট আত্মীয়-স্বজনরা। মুলত প্রতিযোগীতা করে মেলা থেকে জামাইরা মাছ ক্রয় করে শ্বশুর বাড়ীতে নিয়ে যান। তাইতো মেলার প্রতিটি দোকানে সাজানো ছিল দেশীয় জাতের রুই, মৃগেল, কাতলা, চিতল, সিলভার কার্প, পাঙ্গাস, ব্রিগেট, বাঘাইরসহ নানা ধরনের মাছ।

এলাকার প্রবীণদের ভাষ্যমতে, পঞ্জিকা অনুসারে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথমদিনে পাঁচশিরা মেলা বসে। এই দিনে নতুন ধান কাটার উৎসবে কৃষকদের প্রস্ততকৃত চালে প্রথম রান্না উপলক্ষ্যে এই নবান্ন উৎসব। এইদিনে কৃষকরা সারাদেশে বসবাসরত মেয়ে-জামাই ও স্বজনদের আমন্ত্রন করেন। তাদের নিয়ে পাড়া-মহল্লায় বয়ে যায় উৎসবের আমেজ। সাথে চলে পিঠা-পুলি, পায়েস, ক্ষীর, খই ও মুড়ি খাওয়ার ধুম। এই দিনটি পাঁচশিরা বাজারে বসে জেলার বৃহৎ মাছের মেলা।

মাছ ব্যবসায়ীরা কয়েকদিন আগে থেকেই তাদের আড়ৎ ঘরে নানান জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করেন। মেলায় বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষরা উচ্চ মুল্যে এসব মাছ ক্রয় করেন। এ বছর ৩ কেজি থেকে ৩৫ কেজি ওজনের মাছের সমাগম চখে পড়েছে মেলায়। আগের তুলনায় এ বছর মেলায় লোকজনের উপস্থিতিও ছিল বেশী। ক্রয়-বিক্রয়ও হয়েছে প্রচুর। কাউকেই খালি হাতে মেলা থেকে ফিরে যেতে চখে পড়েনি। সাধ্যমত সবাই মাছ ক্রয় করেছেন। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন ভিন্ন কথা। গত বছরের তুলনায় এবার বেঁচা-কেনা কম। তারা লোকশানের সঙ্কায় রয়েছেন।

মেলায় এবার সর্বোচ্চ ৩৫ কেজি ওজনের একটি সিলভার কার্প মাছ বিক্রি হয়েছে ৪২ হাজার টাকায় এবং ১৯ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ বিক্রি হয়েছে ২৫ হাজার টাকায়। মেলার আয়োজক না থাকলেও স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীরা প্রায় ১৫দিন আগে থেকে মেলার জন্য প্রস্তুতি নেন। আশপাশ এলাকায় মাছ ব্যবসায়ীরাই মাইকে প্রচার করেন।

মাছ ব্যবসায়ী নাজির হোসেন জানান , নানান জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে। কাতলা, রুই, মৃগেল ৭’শ থেকে দেড় হাজার টাকা কেজিতে এবং বাঘাআইর ও চিতল মাছ ১৩শ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি আকারের মাছ ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এবার ক্রেতা কম থাকায় এখন পর্যন্ত মাছ বিক্রি তেমন হয়নি। মাছ নিয়ে হয়তো এবার বিপাকে পড়তে হবে।

নবান্ন উৎসব উপলক্ষে হাতিয়র গ্রাম থেকে মাছ কিনতে আসেন এসে শাহারুল বলেন, এই মেলা জামাই-মেয়ে উপলক্ষ্যেই আয়োজন করা হয়, সে কারনে মাছ একটা কিনতেই হয়। ৭ কেজি ওজনের একটি সিলভার কার্প মাছ কিনেছি। এবার মাছের দাম একটু বেশী। তারপরও ভাল লাগছে।

এ উপজেলার মাত্রাই থেকে মাছ কিনতে আসেন জুয়েল হোসেন বলেন, প্রতিবছর মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনি ও স্বজনরা এই দিনের অপেক্ষায় চেয়ে থাকে। কষ্ট হলেও আয়োজন করতে হয়। প্রায় পাঁচ হাজার টাকায় ১০ কেজি ওজনের একটি সিলভার কার্প মাছ কিনেছি। বাড়িতে গেলে নাতি-নাতনিরা খুব খুশি হবে।

কালাই উপজেলা মৎস কর্মকর্তা তৌহিদা মোহতামিম বলেন, মেলায় ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ওঠেছে। বড় বড় মাছ দেখে এ এলাকার চাষীদের আগ্রহ বাড়ছে। আজকের এই মেলায় কমপক্ষে ১ থেকে সোয়া কোটি টাকার মাছ ক্রয়-বিক্রয় হবে। মৎস বিভাগ চাষীদের সবসময় মাছ চাষে পরামর্শ দিয়ে আসছে। আগামীতে এই মেলার পরিধি আরো বাড়বে বলে আমি আশাবাদী।