আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা : সম্পদের অতিব্যবহার, পানিদূষণ, ফাঁরাক্কা বাঁধ নির্মান, ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসসহ নানা কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে উপকূলীয় অঞ্চল। দেশের মোট ভূমির প্রায় ৩২ শতাংশ জুড়ে রয়েছে এবং জনসংখ্যার প্রায় ২৮ শতাংশ মানুষ এই অঞ্চলে বাস করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে এই এলাকাগুলোতে বসবাস ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। কমছে কৃষিজমি বাড়ছে মৎস্যজীবীর সংখ্যা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ত পানি ভেতরের জমিতে প্রবেশে জমির উর্বরতা হ্রাস করে। এতে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন হেক্টর উপকূলের জমি লবণাক্ততায় ভুগছে। জিআইজেড-এর ২০২৩ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, শহরে আশ্রয় নেওয়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসীদের মধ্যে ৫৭ শতাংশই উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার। গবেষণা সংস্থা রামরু ও এসসিএমআরের মতে, ২০১১ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে ১.৬ থেকে ২.৬ কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে গত সোমবার সাতক্ষীরায় পালিত হলো বিশ^ পরিবেশ দিবস।
জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, পৃথিবীর ৪৪ শতাংশ মানুষ সমুদ্রের ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাস করে। এসব এলাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি থাকে। বন্দরসহ নানা অর্থনৈতিক কর্মকা- এখানে ঘটে। এসব কর্মকা- পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলে; যা উপকূলীয় পরিবেশকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব এলাকার ক্ষয় যেমন ঘটছে, তেমনি লবণাক্ত জল প্রবেশ করছে নানা জায়গায়। এতে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। সামুদ্রিক দূষণ হচ্ছে। সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অথচ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই উপকূল এলাকা। একে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকা-। প্রায় ২৮ প্রজাতির চিংড়িসহ ১৮৭ প্রজাতির মাছ শিকার করা হয় উপকূলীয় এলাকায়। এখানে বিশাল অংশের মানুষ মৎস্যজীবী। উপকূলীয় অঞ্চলের ১১ হাজার ৫০০ হেক্টরজুড়ে রয়েছে চিংড়ি চাষ।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাবগুলোর কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ জীবিকা ও নিরাপত্তার খোঁজে দেশের অন্যান্য স্থানে স্থানান্তরিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ২০১৮ সালের মার্চে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভিটেমাটি হারানো বাংলাদেশির সংখ্যা ২০৫০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৩৩ লাখে পৌঁছাতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মোট উদ্বাস্তু জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ। আইডিএমসির সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবাল রিপোর্ট অন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্টে বলা হয়েছে, গত বছর (২০২৪) অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শীর্ষে থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান বিশ্বে পঞ্চম। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার বস্তির প্রায় ৪০% বাসিন্দা উপকূলীয় অঞ্চল থেকে আসা।
এদিকে সাতক্ষীরায় বাস্তুচ্যুত এবং বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ১৫০০ পরিবারকে সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জেলা সদরের ৫টি বস্তি এবং শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ও কৈখালি ইউনিয়নে তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ডিসেম্বর, ২০২৭ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে সাতক্ষীরায় জলবায়ু অভিবাসী এবং বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকিতে থাকা পরিবারের অধিকার সম্পর্কে নাগরিক সমাজের সমর্থনের বর্ধিত কার্যকারিতা খাসভূমি, জলাশয়, সম্পত্তির নিরাপত্তা এবং জনসেবা প্রদান করা হবে। এরফলে সাতক্ষীরায় জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ এবং জলবায়ু সহনশীল সমাজের জন্য উন্নত নীতি পরিবেশ নিশ্চিত হবে বলে মনে করেন সুধীজন।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, পরিবেশ বান্ধব পর্যটন উন্নয়ন ও উপকূলীয় অঞ্চল সুরক্ষায় সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বতৃমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। উপদেষ্টা বলেন, কৃষি জমি সুরক্ষায় ল্যান্ড জোনিং ও কৃষি জমি সুরক্ষা আইনের খসড়া তৈরির কাজ চলছে। উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক করতে হবে। সিঙ্গেল-ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ এবং বনায়ন কার্যক্রম বাড়াতে সরকার কাজ করছে।
পরিবেশবিদদের মতে, উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ রক্ষা করতে হলে কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট রুলস এবং স্পেশাল ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান তৈরি করা দরকার। এখানকার কৃষিজমি সুরক্ষায়ও আইন প্রণয়ন করা দরকার। ভূগর্ভস্থ পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক করা প্রয়োজন। অন্তত উপকূলীয় এলাকায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ হওয়া উচিত। মোট কথা, একটি সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জরুরি, যেখানে বসবাসরত মানুষ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ উভয়েরই উন্নয়ন হবে।
সাতক্ষীরায় বর্ণাঢ্য র্যালি
‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৫ উদযাপন উপলক্ষে সাতক্ষীরায় বর্ণাঢ্য র্যালি , আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল বুধবার সকাল ১০ টায় সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের আয়োজনে সাতক্ষীরা কালেক্টরেট চত্বর হতে এক বর্ণাঢ্য র্যালি বের হয়ে কানেক্টরেট চত্বর প্রদক্ষিন শেষে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এক আলোচনা সভায় মিলিত হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিষ্ণুপদ পালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্য রাখেন পরিবেশ অধিদপ্তর সাতক্ষীরার সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম। জেলা তথ্য অফিসের উচ্চমান সহকারী মনির হোসেনের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহীন চৌধুরী, জেলা জামায়াতের আমীর উপাধ্যক্ষ শহিদুল ইসলাম মুকুল, জেলা সামাজিক ও বন রক্ষক কর্মকর্তা প্রিয়াঙ্কা হালদার, শহর জামায়াতের নায়েবে আমীর ফকরুল হাসান লাভলু, বড়বাজার মাছবাজার ব্যবসায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুর রব, জেলা দূর্ণীতি প্রতিরোধ কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোজাম্মেল হক, সিভিল সার্জন অফিসের সিনিয়র স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অফিসার মো. মাহবুবুর রহমান, সুশীলনের পরিচালক মো. মনির হোসেন, সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আফজাল হোসেন, সিডর নির্বাহী পরিচালক শ্যামল কুমার বিশ্বাস, শিক্ষক পল্টু বাশার, নারীনেতৃ ফরিদা আখতার বিউটি,শিক্ষার্থী জান্নাত, সালেহা জান্নাত প্রমুখ। এসময় বিভিন্ন এনজিও প্রতিনিধি ও স্কুল মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন,মাইক্রো প্লাস্টিকের হাত থেকে বাচতে আমাদের সচেতন হতে হবে, দায়িত্ব পালন করতে হবে। এছাড়া সকল ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এছাড়া খাল, বিলে ও পুকুরে, ড্রেনে প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য না ফেলতে জনগনকে সচেতন করতে প্রচার প্রচারণা চালানোর জোর দাবী জানান বক্তারা।