ধর্ষণের শিকার হয়ে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে আত্মহত্যা করা লামিয়া আক্তারকে (১৭) নিজ গ্রামে বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত শহীদ জসিম উদ্দিনের মেয়ে। গতকাল রোববার রাতে পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার পাংগাশিয়া ইউনিয়নে বাবার কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হয়।

জানাজায়, অংশ নেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তর অঞ্চল) সারজিস আলম, বাংলদেশ জামায়াতে ইসলামী পটুয়াখালী জেলার আমীর এডভোকেট নাজমুল আহসান, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জাহিদ আহসান, পটুয়াখালী ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশনের সভাপতি আব্দুল্লাহ আল নাহিয়ানসহ স্থানীয় রজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

এরআগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা থেকে লামিয়ার লাশ নিয়ে পটুয়াখালী রওয়ানাও হয় স্বজনরা। এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার দুই আসামীর মধ্যে একজনকে গতকাল রিমান্ডে নিয়ে জিজ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ। অন্যদিকে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ দাবি করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। জানাযা শেষে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, একশ দিনের মধ্যে লামিয়া ধর্ষণের আসামীদের বিচার শেষ করে জনসম্মুখে ফাঁসি দিতে হবে।

জানা গেছে, শনিবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক এলাকার ৬ নম্বর রোডের একটি ভাড়া বাসা থেকে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় লামিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় গুলীবিদ্ধ হন এই কিশোরীর বাবা। ১০ দিন পর তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পরে এ বছরের মার্চে পটুয়াখালীর দুমকিতে বাবার কবর জিয়ারত করতে যাওয়ার সময় ধর্ষণের শিকার হন মেয়েটি। দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় ২০ মার্চ দুজনকে আসামী করে মামলা করেন কিশোরী। আসামীদের একজন জনতা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র শাকিব মুন্সি (১৯) এবং অন্যজন স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্র (১৭)। ওইদিন রাতেই প্রধান আসামী শাকিবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আরেক আসামীকেও পরদিন আইনের আওতায় নেওয়ার কথা পুলিশ জানিয়েছিল।

মামলার বরাতে পুলিশ জানায়, তার বাবাকে পটুয়াখালীতে কবরস্থ করা হয়। বাবার কবর জিয়ারত করার পর নানা বাড়ি যাওয়ার সময় দুমকি থানা এলাকায় আসামীরা মেয়েটির পিছু নেয়। এক সময় হঠাৎ মুখ চেপে ধরে তাকে রাস্তার পাশের একটি বাগানে নিয়ে ধর্ষণ করে তারা। ধর্ষণের ঘটনার ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ারও হুমকি দেয়। আলোচিত ওই ধর্ষণের ঘটনার বিচার দাবি করে আন্দোলনের নেতারা বিভিন্ন সময় বিবৃতিও দিয়েছেন। মেয়েটি ঢাকার আদাবর থানা এলাকার শেখেরটেকে পরিবারের সঙ্গে থাকছিল। শনিবার রাতে সেখানেই সে আত্মহত্যা করেন বলে জানায় আদাবর থানা পুলিশ। মেয়েটির চাচা বলেন, মেয়েটি কলেজে পড়ত। সে অত্যন্ত সাহসী মেয়ে ছিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে বুক চিতিয়ে লড়েছিল। কিন্তু বিচারহীনতার ভয়, সমাজের অবজ্ঞা ও মানসিক চাপ তাকে ভেঙে দিল। আজ সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি এবং এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করি। পটুয়াখালীর দুমকি থানার ওসি মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেয়েটির ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।

জুলাই ২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটির চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, বেশ কয়েকজন শহীদ পরিবারের কবরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। অনেকে পরিবার নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। এ সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, মেয়েটাকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে। এ অপমান সইতে না পেরে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। রাজধানীর আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম জাকারিয়া বলেন, এ ঘটনায় মেয়েটির চাচা বাদী হয়ে একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছেন। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে। পুলিশের একটি সূত্র বলেন, আসামি পক্ষের কেউ তাকে কোনো হুমকি দিয়েছে কিনা সে বিষয়টিও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। মেয়েটির মা জানিয়েছিলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই ঢাকার মোহাম্মদপুরে তার স্বামী গুলীবিদ্ধ হন। ১০ দিন পর ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তার শহীদ স্বামীকে দুমকি উপজেলার গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।

ভুক্তভোগীর মা বলেন, ১৮ মার্চ সন্ধ্যায় বাবার কবর জিয়ারত করে নানাবাড়িতে ফেরার পথে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় তার কলেজশিক্ষার্থী মেয়ে। ধর্ষণের সময় এজাহারভুক্ত আসামীরা তার নগ্ন ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলে। এরপর ভুক্তভোগী তার মা ও পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে ২০ মার্চ থানায় গিয়ে অভিযোগ করে। সন্ধ্যায় অভিযোগটি মামলা হিসেবে রুজু হয়। মামলার এজাহারে উপজেলার একটি ইউনিয়নের দুজনের নাম উল্লেখ করা হয়। মামলা হওয়ার দিন রাতে এজাহারভুক্ত ১৭ বছর বয়সী কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ২১ মার্চ অন্য আসামীকে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদালতের মাধ্যমে তাদের যশোর শিশু সংশোধনাগারে পাঠানো হয়।

আত্মহত্যার আগে কী বলেছিলেন লামিয়া: আত্মহত্যার কিছু সময় আগে লামিয়ার সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবরিনা আফরোজ শ্রাবন্তী। কাটানো সেই সময়ের মর্মস্পর্শী বর্ণনা তুলে ধরে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন শ্রাবন্তী। সাবরিনা আফরোজ জানান, ‘আত্মহত্যার কয়েক ঘণ্টা আগেও তিনি লামিয়ার বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলেন। গল্প করেছেন, খাওয়া-দাওয়া করেছেন। বিদায়ের সময় লামিয়ার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল অসহায়তা ও ক্ষোভ, ‘আল্লাহ যা করে, সেটা নাকি ভালোর জন্যই করে। আমার কি ভালো করসে বলতে পারেন? আমার সঙ্গে খালি খারাপই হইসে!

সাবরিনা আফরোজের মতে, লামিয়ার মৃত্যু শুধু ধর্ষণের ঘটনার ট্রমা থেকে নয়, বরং সমাজের ফিসফাস, কটূক্তি, সন্দেহ, ও চরিত্রহরণের সংস্কৃতি তার আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। বাসার আশপাশের মানুষের কানাঘুসা ও নোংরা ইঙ্গিত তাকে মানসিকভাবে এমন পর্যায়ে ঠেলে দেয়, যেখানে আর বেঁচে থাকার শক্তি ছিল না। লামিয়ার মা এ বিষয়ে বলেছিলেন, মেয়ের ইন্টার পরীক্ষা শেষ হলেই তারা দূরে কোথাও চলে যাবেন, যেখানে কেউ চিনবে না, আঙুল তুলবে না। তবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই থেমে গেল লামিয়ার জীবন। এই ঘটনায় শুধু ধর্ষণকারীরাই নয় বরং যারা ভুক্তভোগীর চরিত্র নিয়ে কটূক্তি করেছে, যারা তার প্রতি অবজ্ঞা ছড়িয়েছে, তারাও কম দায়ী নয় এমন মন্তব্য করেছেন সাবরিনা আফরোজ। লামিয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ফের একবার প্রমাণ হলো, ধর্ষণের পর শুধু অপরাধ নয়, সামাজিক বৈষম্য ও অবজ্ঞাও একটি মেয়েকে ধ্বংস করে দিতে পারে। একজন মেয়ের সম্মতি ছাড়া যদি কিছু ঘটে, সেখানে মেয়েটার অপরাধ কোথায়? সাবরিনা আফরোজের এই প্রশ্ন গোটা সমাজের বিবেককে নাড়া দেওয়ার মতো। লামিয়ার মৃত্যু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির চেয়েও বড়। এটি পুরো সমাজের এক নির্মম, বিকৃত মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। যেখানে একজন নির্যাতিতাও নিরাপদ নয়, যেখানে দোষীদের বিচার অপেক্ষার চেয়েও দ্রুত হয় ভুক্তভোগীকে দোষারোপ। যেখানে ভিকটিম-ব্লেমিং আজও আমাদের নষ্ট সংস্কৃতির অংশ।

প্রকাশ্যে ফাঁসি চাইলেন সারজিস আলম: ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ দাবি করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, ধর্ষকদের প্রকাশ্যে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে এবং এই শাস্তির ভিডিও ফুটেজ মানুষের সামনে দেখানো উচিত। শনিবার রাতে ধর্ষণের শিকার লামিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় গণমাধ্যমে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় এ দাবি জানান তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদের মেয়ে লামিয়াকে দেখতে হাসপাতালে এলে তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, লামিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় পুরো দেশের মানুষ মর্মাহত। নতুন বাংলাদেশের জন্য যে ভাই জীবন দিয়েছেন তার কন্যার সঙ্গে এমন একটি নৃশংস ঘটনা ঘটে গেছে।

পৃথিবীর কেউই এমন একটা ঘটনা প্রত্যাশা করে না। সারজিস আলম বলেন, কিছুদিন আগে ঠিক একইভাবে আমরা আছিয়া নামে আরেক বোনকে হারিয়েছিলাম। এরকম ঘটনায় জড়িত মানুষরূপী পশুদের দৃশ্যমান ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। আমরা যখন হাসপাতালে লামিয়াকে দেখতে এলাম তার মা আমাদের কাছে বারবার প্রশ্ন করছিল, তোমরা কি আমার লামিয়াকে ফিরিয়ে দিতে পারবে? এর কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। তিনি আসামীদের জামিনের বিষয়েও কথা বলেছেন। সারজিস আলম জানিয়েছেন, যারা ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধে জড়িত, তাদের জামিন দেওয়া উচিত নয়। তিনি আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যারা এই নরপশুদের জামিনের জন্য আদালতে হাজির হন, তারা নিজের বিবেক হারিয়ে ফেলেছেন।