রমযানে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকলেও রমযান যেতে না যেতে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে হঠাৎ করে ভরা মওসুমে পেঁয়াজের দাম এক লাফে অস্বাভাবিক হারে বাড়তে শুরু করেছে। যার প্রভাব ইতোমধ্যে খুলনাঞ্চলের বাজারে পড়তে শুরু করেছে। কয়েকদিন আগের ৩০-৩৫ টাকার পেঁয়াজ এখন খুলনার পাইকারী বাজারে বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৪৮-৫০ টাকা দরে। নগরীর পাইকারী বাজার ঘুরে সেই পেঁয়াজ খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা দরে।

হঠাৎ করে পেঁয়াজের বাড়তি দামের কারণ হিসাবে জানা গেছে, বাজারে সরবরাহের জন্য কৃষকের কাছ থেকে যারা সরাসরি পেঁয়াজ কিনেন, তারা সেই পেঁয়াজ বাজারে না ছেড়ে অবৈধভাবে মজুত শুরু করেছেন। ওই চক্রটি ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের অজুহাত সামনে এনে বাজারে অস্থিরতার পাঁয়তারা করছে। এমন অজুহাতে পেয়াজের ভরা মওসুমে দেশের উৎপাদিত পেয়াজের অবৈধ মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করছে তারা বলে সূত্রে জানা গেছে।

খুলনার বাজারে পেয়াজের এমন দামের পরিবর্তনে ক্রেতাদের সাধারন দিশেহারা এবং সামনে আরো দাম বৃদ্ধির ব্যাপারেও শঙ্কিত তারা। পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে দাম বৃদ্ধির কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাধারণ ক্রেতারা। পেয়াজের দাম বৃদ্ধি ও সামনে আরো দাম বাড়তে পারে এমন সঙ্কায় অধিকাংশ ভোক্তারা বাড়ীতে পেয়াজ মজুতের জন্য পেয়াজ সরবরাহ করছেন। যে কারণে স্বাভাবিক কেনাবেচার তুলনায় বর্তমানে নগরীর বাজারে পেয়াজের ক্রেতা চাহিদা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন বাস্তবতায় পেঁয়াজের বাজার রমজানের মতো সহনীয় রাখতে সাধারন ভোক্তারা সংশ্লিষ্টদের প্রতি অবৈধ মজুদকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত বাজার মনিংটরিংয়ের দাবি জানিয়েছেন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খুলনা সূত্র জানা গেছে, পেঁয়াজের দাম কারা বাড়িয়েছে, তা চিহ্নিত করে তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে এ ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহন করবেন।

খুলনা মহানগরীর পাইকারী পেঁয়াজের বাজার ঘুরে জানা গেছে, বর্তমানে খুলনায় ঝিনাইদহের শোলকূপা, লাঙ্গলবাঁধ, ফরিদপুর রাজবাড়ীর পানষা, কুষ্টিয়ার কুমারখালি, পানথি, চৌরঙ্গী, রাশগ্রাম, শ্মশান, চাঁকমোহড়া, হাজিরহাটসহ বিভিন্ন হাট ও মুকাম হতে বাজারে সরবরাহের জন্য কৃষকের কাছ থেকে যারা সরাসরি পেঁয়াজ কিনেন, তারা সেই পেঁয়াজ বাজারে না ছেড়ে অবৈধভাবে মজুত শুরু করেছেন। পাশাপাশি বাজারে পেঁয়াজ সরবরাহের জন্য ব্যাপারীরা পেঁয়াজের যে দাম বলছেন, তারা (মজুদকারী) কয়েক মাস পর বাড়তি দামে ওই পেয়াজ বিক্রির বাড়তি দামে পেঁয়াজ কিনছে, যে কারণে মুকামে বা হাটে পেয়াজের দাম বর্তমানে উর্ধ্বগতি। তারা (ব্যাপারীরা) বলছেন, যদি পেঁয়াজের অবৈধ মজুদ বন্ধ করা যায়, তবে দাম আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। বর্তমানে মুকামে প্রতি মন পেয়াজ কেনা লাগছে ১৮০০-১৯০০ টাকা দরে, সে হিসাবে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়ে ৪৫-৪৭ টাকা। এরপর পাইকারি ঘর পর্যন্ত পৌচ্ছাতে খরচ রয়েছে। সামান্য লাভ তো বিক্রি করতেই হয়।

পাইকারি ব্যবসায়ীদের বিপরীতে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমরা নগরীর পাইকারি বাজার হতে পেঁয়াজ কিনে খুচরা বাজারে বিক্রি করি। যে সময় যে দামে কিনি, সেই সময় সেই দামে বিক্রি করি, সামান্য লাভে বিক্রি করি।

খুলনা বাজারে পেঁয়াজের হঠাৎ উর্ধ্বগতির বিষয়ে সাধারন ভোক্তারা বলছেন, প্রতি বছর পেঁয়াজ নিয়ে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে থাকেন। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ইতোমধ্যে সিন্ডিকেট শুরু হয়ে গেছে। ঈদের আগে অর্থাৎ রমযানে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ তারা কিনেছেন ৩০-৩৫ টাকা দরে। ঈদের পর তা ৪০ টাকা এবং এখন কেনা লাগছে ৬০ টাকা দরে। শনিবার নিউ মার্কেট, ময়লাপোতা খুচরা বাজারে পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৬০ টাকা ও দৌলতপুর বাজারে ৫৩ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বলে দেখা গেছে।

কেসিসির সোনাডাঙ্গা পাইকারী বাজারে ব্যবসায়ী মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, বর্তমানে চাহিদার কারণে পেয়াজের দাম বাড়তি। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ভোক্তা ভাবছে সামনে পেঁয়াজের দাম আরো বাড়বে, ওই সঙ্কায় তারা বাসা-বাড়ীতে পেঁয়াজ সরবরাহ শুরু করেছে। এছাড়া কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এল.সি পেয়াজ আসবে না, ওই শঙ্কায় পেয়াজ মজুত করছে। এ কারণে চাহিদা ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চাহিদার কারণে দাম বাড়তি। তবে আশা করা যাচ্ছে সামনে দাম কমে যাবে।

মের্সাস জোনাকী ভান্ডারের সত্বাধিকারী আবু সুফিয়ান জানান, বর্তমানে মুকামে পেয়াজের দাম বেশি। মুকামে মজুত করার জন্য কৃষকের কাছ থেকে অনেকে বাড়তি দামে পেঁয়াজ কিনছে। যে কারনে ব্যাপারীদেরও বাজার ঠিক রাখতে বাড়তি দামে পেয়াজ কেনা লাগছে। ওই প্রভাব গোটা বাজারের উপর পড়ছে। খুচরা বিক্রেতা হারুন মোড়ল জানান, ‘দাম বাড়ার পেছনে খুচরা বিক্রেতাদের কোনো হাত নেই। পাইকারি বাজার থেকে যে দামে কিনি, সেই অনুযায়ী বিক্রি করি। তবে যতটুকু জানি পেঁয়াজ মজুদ করার কারণে দাম বাড়তি।

নগরীর ময়লাপোতা বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী কাওসার জানান, সোনাডাঙ্গা পাইকারি বাজার হতে বাছাই করা পেয়াজ ৫৪ টাকা কেজি দরে কেনা লাগছে। এরপর খরচ আছে, খুচরা ৬০ টাকা দরে বিক্রি করছি। যে সময় যেমন কেনা, সেই সময় সময় তেমন দামে বিক্রি করি। রাখি বা মজুতদের কারণে বর্তমানে পেয়াজের দাম বেড়েছে।

নগরীর নিউ মার্কেট বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী কালু জানান, দাম তো আর আমাদের হাতে নেই। পাইকারি বাজার হতে যে দামে কিনি, সামান্য লাভে বিক্রি করি। সোনাডাঙ্গা পাইকারি বাজার হতে ৫৩ টাকা দরে প্রতি কেজি পেয়াজ কিনেছি। খরচ-খরচা বাদে কয় টাকা দরে বিক্রি করবো বলেন। প্রতি কেজি পেয়াজ ৬০ টাকা দরে বিক্রি করছি। যখন দাম কমবে, তখন কম দামে বিক্রি করবো।

সু-শাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট কুদরত-ই খুদা জানান, সরকার রমযানে বাজার কিছু নিয়ন্ত্রনে করলেও সিন্ডিকেট কিন্তুএখনো সক্রীয়। তার প্রমান কয়েক দিনের ব্যবধানে পেয়াজের দাম দ্বিগুন। সিন্ডিকেটদের যদি নিয়ন্ত্রন না করা যায়, যদি বাজার মনিটরিং জোরদার না করা যায় তবে বাজার আবার নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়বে। পেয়াজের সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষন অধিদপ্তরের কঠোর ভূমিকায় থাকতে হবে।

এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষন খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মাদ সেলিম জানান, খুলনার নিত্যপণ্যের বাজারে আমরা নিয়মিত তদারকিসহ অভিযান অব্যহত রেখেছি। ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘিত করলে ওই ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা হিসাবে জরিমানা আরোপসহ আদায় করা হচ্ছে। যেহেতু পেঁয়াজের মজুতকে কেন্দ্র করে দাম বৃদ্ধির বিষয়ে অবগত করা হয়েছে, এ ব্যাপারে বাজার মনিটরিং করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। কোনো ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠান সরকার প্রদত্ত নিয়মনীতির বাইরে ব্যবসা পরিচালনা করলে তাদের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তর হতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।