গত দুই দশকে দেশে বিভিন্ন প্রকার ফল উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এসব ফল অভ্যন্তরীণ চাহিদাও মেটাচ্ছে। এতদসত্ত্বেও বিদেশ থেকে নানাবিধ ফল আমদানির প্রবণতাও অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে।

চলতি জ্যৈষ্ঠের মধুমাসে রসালো ফলে জমজমাট বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ-শহর-জনপদ। এই সময়ের ফলের মধ্যে আম, লিচু, কাঁঠাল, আনারস, জাম, জামরুল প্রভৃতি অন্যতম। বাণিজ্যিকভাবে আম, লিচু, পেয়ারা, জাম, তরমুজ, লটকন, আনারস, বেল, কমলা, কলাসহ প্রায় সব ধরনের দেশী ফল ব্যাপক হারে উৎপাদিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিদেশী জাতের বিভিন্ন প্রকার ফল উৎপাদনও শুরু হয়েছে। এই তালিকায় আছে ড্রাগন, স্ট্রবেরি, মাল্টা, রাম্বুটান, রকমেলন ইত্যাদি। ড্রাগনসহ বাহারি সব বিদেশী ফল এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। দেশে মাল্টা ও কমলার উৎপাদনও লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলে ভালো হয় আম, লিচু, কলা, কাঁঠাল, পেয়ারা, কুল, তরমুজ, আলুবোখারা, পিচফল ইত্যাদি। মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে ভালো হয় আম, জাম, গোলাপজাম, জামরুল, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কুল, কলা, বেল, আনারস, হরীতকী, বহেড়া, আমলকী, তাল, খেজুর, ডেউয়া, চালতা, জলপাই, পানিফল, করমচা, কামরাঙা ইত্যাদি। পূর্বাঞ্চলে ভালো হয় আনারস, লেবু, মাল্টা, কমলা, পেয়ারা, ডেফল, তৈকর, ডেউয়া, কুল, কামরাঙা, অরবরই, বিলিম্বি ইত্যাদি। পাহাড়ি অঞ্চলে ভালো হয় আনারস, কাঁঠাল, মাল্টা, আ¤্রপালি ও রাঙ্গোয়াই আম, বিলিম্বি, প্যাশন ফল, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, লুকলুকি, গুটগুইট্টা, চুকুর বা আমিলা, চিনার, মারফা, বেল, মাল্টা, কমলালেবু, লেবু, তেঁতুল ইত্যাদি। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে ভালো হয় নারিকেল, বাতাবিলেবু, পেয়ারা, সফেদা, চালতা, কদবেল, অরবরই, আমড়া, চুকুর, ক্ষুদিজাম, তরমুজ, আমরুল, বিলাতি গাব, হরীতকী, বহেড়া, আমলকী, কেওড়া, গোলফল, তাল, পানিফল, বৈঁচি, তেঁতুল ইত্যাদি। বছরের যে কোনো সময় ফল পাওয়ার জন্য বেছে নেয়া যেতে পারে নারিকেল, পেঁপে, কলা, আনারস, সফেদা ইত্যাদি ফল। এখন পেয়ারাও বারোমাস ধরছে। জাত বুঝে গাছ লাগাতে পারলে আমও ৭ মাস ধরে পাওয়া সম্ভব। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ৪ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে ফলের আবাদ হয়েছিল এবং ফলন হয়েছিল ৮৭ লাখ ৮৬ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে এই ফলের জমি ও উৎপাদনের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় আম। এক সময় শুধু রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে হিমসাগর, গোপালভোগ, ল্যাংড়া ও ফজলি আমের ওপর দেশের চাষিরা নির্ভরশীল ছিলেন। এক যুগ আগে আম্রপালি আমের উদ্ভাবন আম চাষের সব ভৌগোলিক বাধা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এখন দেশের মোট উৎপাদিত আমের ৪০ শতাংশ এই জাতের। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে আমপালির চাষ ব্যাপক হারে বেড়েছে। তবে সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, রংপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে প্রচুর আম হয়। এমনকি পাহাড়ি এলাকা থেকে শুরু করে লবণাক্ত অঞ্চল, অনাবাদি সিলেটসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

আমদানির প্রবণতা

দেশি ফলের চাষের পাশাপাশি বেড়েছে বিদেশী ফল আমদানিও। ডলার-সংকটের কারণে ফল আমদানির ওপর বাড়তি নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানো হয়, তা সত্ত্বেও ফল আমদানি কমেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রধান ও অপ্রধান মিলিয়ে ২৫-৩০ জাতের বিদেশী ফল আমদানি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় খেজুর, আপেল, আঙুর, কমলা, মাল্টা, আনার ও নাশপাতি। বিশ্বের ৪৬টি দেশ থেকে ওই ছয়টি ফল আমদানি হয়। এর মধ্যে চীন, ব্রাজিল, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ভুটান, মিসর, দক্ষিণ আফ্রিকা অন্যতম। এসব ফলের মধ্যে এখন সবচেয়ে কম দামে পাওয়া যাচ্ছে সবুজ কমলা ও মাল্টা। বিক্রেতারা বলছেন, ভারত থেকে আমদানির পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত সবুজ মাল্টা ও কমলাও বাজারে আসছে। একই কারণে ড্রাগন, স্ট্রবেরিসহ অনেক বিদেশী ফলের দাম মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে আসছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সময়ে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার ফল আমদানি হচ্ছে। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ; অর্থাৎ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার কমলা ও আপেল আমদানি হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় সোয়া ৪ লাখ টন ফল আমদানি হয়েছে। তবে একজন কৃষি কর্মকর্তার দাবি, প্রতিবছর দেশে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। ফল আমদানির পরিমাণ এখন দিনে দিনে কমছে। দেশেই এখন নতুন নতুন বিদেশী ফল উৎপাদন হচ্ছে। এই প্রবণতা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে, দেশের টাকা দেশেই থাকবে।

ফল খাওয়া দ্বিগুণ বেড়েছে

কৃষি ও খাদ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর তথ্য বলছে, মাত্র এক দশক আগেও দেশে জনপ্রতি ফলগ্রহণের পরিমাণ ছিল গড়ে মাত্র ৩৫ গ্রাম। ২০২২ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ গ্রামে। এতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে দেড় দশক ধরে চলা বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প। ফলের উৎপাদন বাড়াতে এর বাইরে ভূমিকা রাখছে আরো কয়েকটি প্রকল্প। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা গেছে, গত এক যুগ আগে একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে যতো গ্রাম ফল খেতো, এখন তা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২২ সাল শেষে দেশের একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৯৫ দশমিক ৪ গ্রাম ফল খায়। পুষ্টি প্রকল্পের একজন কর্মকর্তার মতে, দেশে এখন সারাবছরই আম ও কাঁঠাল পাওয়া যায়। কাটিমন আম বারো মাসেই উপাদন হয়। বারি-৬ জাতের কাঁঠালও বারোমাসি। মৌসুমের বাইরেও দেশীয় ফল যেনো সারাবছর পাওয়া যায়, সে লক্ষ্যে তারা বারোমাসি ফলের জাতগুলোকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের বাম্পার ফলন

শিবগঞ্জ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) সংবাদদাতা : চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় এবার আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। সেকারণে আমের সাথে সংশ্লিষ্ট চাষি, ব্যবসায়ী, বাগান মালিক, এমনকি খেটে খাওয়া মানুষেরাও আনন্দিত।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অফিস সূত্রে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় চলতি মৌসুমে ৩৭ হাজার ৫০৪ হেক্টর জমিতে ৩২ জাতের আম বাগান গড়ে তোলা হয়েছে।

লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৫৯১ মেট্রিক টন। টাকার অংকে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার আম উৎসাহিত হবে। গত এপ্রিলে কয়েক সপ্তাহ একটানা বৃষ্টি না হওয়ায় কিছু গুটি ঝরে পড়ে। পরে বৃষ্টিপাত হওয়ায় আম দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামনে দুই এক সপ্তাহের মধ্যে আম পরিপক্ব হলে সংগ্রহ শুরু হবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর, শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর, নাচোল ও ভোলাহাট উপজেলায় ফজলি, লক্ষণ ভোগ, গোপাল ভোগ, মোহনভোগ, কিষান ভোগ, খিরসাথ, নোংরা নাগ, ফজলি, আম্রপালি, বারি-১১, বারি-৪,ব্যানানা ম্যাংগো, আশি^না, হাড়িভাঙ্গা, কাঁচা মিঠা, কাটিমনসহ দেশী-বিদেশী ৩২ জাতের আম বাগান গড়ে তোলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে শিবগঞ্জের আমচাষী শহিদুল ইসলাম, রানীহাটি গ্রামের আহসান আলী কালু, নাসির উদ্দিন, তারেক মাহমুদ, আনসার আলীসহ স্থানীয় অন্যান্য আম চাষিরা বলেন, আমের মুকুল আসার পর থেকে আমরা যতœ নিয়েছি। এবার আমের অন-ইয়ার হবার ফলে প্রচুর মুকুল হয়েছিল, আমের গুটিও ছিল কিন্তু গত মাসে কয়েক সপ্তাহের একটানা বৃষ্টি না হওয়ায় অনেক গুটি ঝরে গেলেও বৃষ্টির পরে আম বৃদ্ধি পেয়েছে। গাছে এখন প্রচুর আম। দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে আম সংগ্রহ করে বাজারজাত করা হবে বলে তারা জানান।