দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জীবন-অর্থনীতিকে একসময় বদলে দিয়েছিল ‘সাদা সোনা’ খ্যাত চিংড়ি। চিংড়ি চাষের ঘেরগুলো সৃষ্টি করেছিল হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান, আর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে এনেছিল টেকসই অবদান। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই সফলতার গল্প এখন বিপর্যয়ের পথে। সুন্দরবনের নদ-নদীতে ছড়িয়ে পড়া কীটনাশকের বিষাক্ত ঢেউ উপকূলের চিংড়ি চাষকে মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

প্রতিদিন জোয়ারের সময় ঘেরে লবণ পানি তুলেই চাষীরা মাছ বড় করেন। কিন্তু এখন সেই জোয়ারের পানিই হয়ে উঠছে সর্বনাশের কারণ। অভিযোগ আছে — সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-খালে কিছু অসাধু ব্যক্তি মাছ শিকার করতে নির্বিচারে কীটনাশক ব্যবহার করছে। জোয়ারের সাথে সেই বিষাক্ত পানি সরাসরি ঘেরে ঢুকে যাচ্ছে, আর সেই পানির বিষক্রিয়ায় মরছে চিংড়ির পোনা; ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যান্য মাছের উৎপাদন। ফলে বহু চাষী ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন, কেউ কেউ বাধ্য হচ্ছেন ঘের বিক্রি করে বিকল্প পেশায় ঝুঁকতে।

একজন চাষী বলেন — জোয়ারের পানি ঘেরে ঢোকানোর পরই মাছ মারা যাচ্ছে; আগে যে পানিতে মাছ বড় হতো, এখন সেই পানি-ই চাষের ঘেরকে ধ্বংস করছে।

আরেক নারী চাষীর ভাষায় — “জোয়ারের পানি এলেই মাছ মরে। তখনই বুঝি যে নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে গেছে।”

আরেক চাষী জানান — “জোয়ারের পানি ঢুকতেই ঘেরে থাকা সব পোনা মরতে শুরু করে।”

পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রশাসনের নজরেও এসেছে। বন বিভাগের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করছেন — সুন্দরবনের নদ-নদীতে কীটনাশক ব্যবহার করে মাছ ধরার প্রবণতা বাড়ছে। এতে শুধু নদীর মাছ নয় — অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ, জীববৈচিত্র্য, নদীপ্রবাহ নির্ভর স্থানীয় অর্থনীতি — সবই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী জানান — সীমান্তবর্তী এলাকায় অনুমোদিত ও অননুমোদিত কীটনাশকের দোকানের সংখ্যা বাড়ছে। এসব কীটনাশকের অনেকগুলো ভারত থেকে চোরা পথে আসছে। তিনি বলেন — বন বিভাগের পক্ষ থেকে বনের ভেতরে ব্যবহারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, তবে এই দোকানগুলোতে নজরদারি ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া এখন অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগেরও উদ্যোগী হওয়া দরকার।

বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য চিংড়ির সবচেয়ে বড় উৎস দক্ষিণাঞ্চল। এ অঞ্চলের চাষীদের হাত ধরে তৈরি হওয়া বৈদেশিক আয়ের সাফল্য এখন বিষাক্ত জোয়ারের ধাক্কায় হারিয়ে যাওয়ার পথে। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া হলে — উপকূলের সাদা সোনার এই স্বপ্ন ভেসে যেতে পারে দূষিত পানির স্রোতে।