কাশ্মীর নিয়ে সংঘাতের জেরে ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের আকাশপথ ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে এয়ারলাইন্সগুলোর যে ক্ষতি হবে তাতে দেখা যায়, ভারতের লোকসান হবে অনেক বেশি। অন্যদিকে দুই দেশের যুদ্ধের পক্ষে বৃহৎ শক্তিসহ বহিঃশক্তির কোনো সমর্থন মিলছে না বলে জানা গেছে।

পাকিস্তানের আকাশ পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৭ হাজার ২৬০ কোটি রূপি। একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় ২০১৯ সালে ভারতের ক্ষতি হয়েছিল অন্তত ৬৪ মিলিয়ন ডলারের মতো। এবারের নিষেধাজ্ঞায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে দিল্লি ও কলকাতা এয়ারপোর্ট। উল্লেখ্য, গত ১ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত প্রতিদিন ভোর রাত ৪টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত করাচি ও লাহোর শহরের নির্ধারিত অংশের আকাশপথ বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দেয় পাকিস্তান। নিরাপত্তার কারণে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানানো হয়। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানের বিমান পরিবহন সংস্থাগুলোর জন্য আকাশসীমা বন্ধ করে ভারত। ভারত সরকারের এক নোটিশে বলা হয়েছে, ৩০ এপ্রিল থেকে ২৩ মে পর্যন্ত পাকিস্তানি উড়োজাহাজের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে।

রুট-সংকটে ভারত

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি এয়ারপোর্ট থেকে অন্তত ৬টি এবং কলকাতা থেকে কমপক্ষে ৩টি আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচলের জন্য পাকিস্তানের আকাশ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পুরো মধ্য এশিয়ার দেশসমূহ এবং ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে বিমান চলাচলের জন্য দিল্লি ও কলকাতা এয়ারপোর্টকে পাকিস্তানের আকাশ ব্যবহার করতে হয়। পাকিস্তানের আকাশপথ বন্ধ হওয়ায় ভারত মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের বহুসংখ্যক বিমান বন্দরে সরাসরি পৌঁছাতে পারবে না। পাকিস্তানের দীর্ঘ সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার সীমান্ত এড়াতে তাদেরকে হয় আরব সাগর ঘুরে যাবার অথবা চীনের আকাশ ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়বে। এছাড়া পাকিস্তানকে এড়াতে হলে মুম্বাই ও চেন্নাই এয়ারপোর্টের উপর বাড়তি চাপ পড়বে। প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ ভারতীয় ফ্লাইট পাকিস্তানের আকাশসীমা অতিক্রম করে বলে জানা গেছে। আর উত্তর ভারতের শহরগুলো থেকে প্রতি সপ্তাহে ৮০০-এর বেশি ফ্লাইট উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়াসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গন্তব্যে যাতায়াত করে। মাসের হিসাবে বিমানের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করে থাকে।

অন্যদিকে ভারতের আকাশ ব্যবহার করে পাকিস্তান নিয়মিতভাবে কেবল মালয়েশিয়ায় (কুয়ালালামপুর) ফ্লাইট পরিচালনা করে। এছাড়া অনিয়মিত ফ্লাইট চলাচল করে মাত্র ৩টি রুটে। এগুলো হলো, শ্রীলঙ্কা (কলম্বো), থাইল্যান্ড (ব্যাংকক) ও বাংলাদেশ (ঢাকা)। পাকিস্তানকে বিকল্প রুটে এসব দেশে যেতে হলে আরব সাগর অথবা চীন-মায়ানমারের আকাশ পথ ব্যবহার করতে হবে। তবে এসব রুটে পাকিস্তানের নিয়মিত ফ্লাইটের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

ভারতের আর্থিক ক্ষতি

পাকিস্তান ভারতের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে ভারতকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে এয়ার ইন্ডিয়া এক বছরে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ব্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে বলে জানিয়েছে এবং এই ক্ষতির জন্য কেন্দ্রের কাছে অর্থনৈতিক সহায়তা চেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। গত ২৭ এপ্রিল ভারতের বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়কে পাঠানো এক চিঠিতে এয়ার ইন্ডিয়া জানিয়েছে, পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ থাকলে অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ, দীর্ঘতর যাত্রার সময় ও অতিরিক্ত ক্রু ব্যবস্থার কারণে তাদের বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ৫৯১ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই চিঠি পাঠানোর আগে কেন্দ্রীয় সরকার এয়ার ইন্ডিয়াকে আকাশপথ বন্ধের কারণে সৃষ্ট প্রভাব মূল্যায়নের নির্দেশ দেয়। জানা গেছে, সংস্থাটি সরকারকে অনুরোধ করেছে যাতে ক্ষতি মোকাবেলায় চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কিছু নতুন ওভারফ্লাইট রুট নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হয় এবং দীর্ঘতর রুটে অতিরিক্ত পাইলট নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। পাশাপাশি ট্যাক্স ছাড় ও জ্বালানির ওপর কিছু ছাড় দেয়ারও অনুরোধ করা হয়েছে।

বহিঃশক্তির সমর্থন মিলছে না

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ শুরুর পক্ষে বহিঃশক্তির সমর্থন মিলছে না। বরং ভারতকে ইতোমধ্যে কিছু দেশ সংযমের পরিচয় দেয়ার উপদেশ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের প্রতিবেশি চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব। জাতিসংঘও এমন মনোভাব ব্যক্ত করেছে। গত ২ মে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স সতর্ক করেছেন যাতে ভারতীয় প্রতিক্রিয়া এই অঞ্চলে আরেকটি বড় সংঘাতের দিকে না নিয়ে যায়। ফক্স নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভ্যান্স বলেন, “আমাদের আশা, ভারত এমনভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে যা বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘর্ষ সৃষ্টি করবে না।” অপর এক বিবৃতিতে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর পরামর্শ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। উত্তেজনা কমাতে ভারতকে পাকিস্তানের সাথে ‘কাজ’ করতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র।

আর চীন জানিয়ে দিয়েছে তারা সবসময় পাকিস্তানের সাথে আছে। লাহোরে নিযুক্ত চীনের কনসাল জেনারেল ঝাও শিরেন বলেন, সব পরিস্থিতিতেÑ সাফল্যের মুহূর্তে হোক বা সংকটের সময়- চীন পাকিস্তানের পাশে থাকবে। পাশাপাশি, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে তিনি সংলাপ ও কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। গত ১ মে দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জনানো হয়। ঝাও শিরেন বলেন, চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি), অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জাতীয় নিরাপত্তা অবকাঠামোসহ বিভিন্ন কৌশলগত খাতে দুই দেশের অংশীদারিত্ব দৃঢ় ও দীর্ঘদিনের। তিনি জোর দিয়ে বলেন, চীন পাকিস্তানের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

এছাড়াও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সৌদি আরব। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উত্তেজনা কমাতে এবং কূটনৈতিক উপায়ে বিরোধ সমাধান করতে দেশ দুটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। গত ৩০ এপ্রিল সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানায়।