সুন্দরবনে মধু আহরণ মওসুম শুরু হলেও দস্যু আতঙ্কে এবার অর্ধেকে নেমেছে মৌয়াল ও নৌকার সংখ্যা। পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা স্টেশন থেকে মাত্র ১৮টি নৌকাকে মধু আহরণের অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছে, যা গত বছরের প্রথম দিনের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।

স্থানীয় মৌয়ালরা জানান, সম্প্রতি সুন্দরবনে দস্যুদের পুনরাবির্ভাব তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। খুড়িয়াখালী গ্রামের মজিদ ফরাজী (৫৫) বলেন, ‘১৫ বছর ধরে মধু সংগ্রহ করি, কিন্তু এবার প্রথম যাচ্ছি না। দস্যুরা ধরে নিয়ে দুই-তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।’ মধু ব্যবসায়ীরাও এবার কম দাদন দিচ্ছেন। রাসেল আহমেদ নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘গতবার নৌকাপ্রতি দুই-তিন লাখ টাকা দাদন দিলেও এবার এক থেকে দেড় লাখ টাকায় সীমিত রাখছি।’

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ‘২০২৩-২৪ অর্থবছরে শরণখোলা রেঞ্জ থেকে ৫১৪ কুইন্টাল মধু ও ১৫৪ কুইন্টাল মোম সংগ্রহ করা হয়েছিল। এবার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ৫৫০ ও ১৬০ কুইন্টাল, যা পাসের সংখ্যার ওপর নির্ভর করছে।’ পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক রানা দেব নিশ্চিত করেছেন, মৌয়ালদের নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দ্রুত বন কর্মকর্তাদের জানানোর জন্য মৌয়ালদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে , এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সুন্দরবনে মধু আহরণের মওসুম ধরা হয়েছে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আগে যেখানে মধু সংগ্রহের সময়সীমা নির্ধারণ ছিলো তিন মাস, সেখানে ২০২২ সাল থেকে এপ্রিল ও মে এ দুই মাস মধু সংগ্রহের জন্য মৌয়ালদের পাস-পারমিট দিয়ে আসছে বন বিভাগ। এবারের মওসুমে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের ১০৫০ কুইন্টাল মধু এবং ২৫০ কুইন্টাল মোম আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর মধু না পাওয়ায় আহরণ হয়েছিল ৫৪১ কুইন্টাল এবং ১৬১ কুইন্টাল মোম। মধু সংগ্রহের নিয়ম এবং বন আইনের নীতিমালা অনুসরণ করে ১ এপ্রিল সকাল থেকেই মৌয়ালদের পাস (অনুমতিপত্র) দেওয়া শুরু হয়েছে। ১ এপ্রিল পশ্চিম বিভাগের দুপুর ১ টা পর্যন্ত নলিয়ান স্টেশনে ৩ টি, কালাবগী স্টেশনে ২ টি বানিয়াখালী স্টেশনে ৭ টি, কাশিয়াবাদ স্টেশনে ১৯ টি, কোবাদক স্টেশনে ৭ টি, বুড়িগোয়ালিনি স্টেশনে ৯ টি, কদমতলা স্টেশনে ৩ টি ও কৈখালী স্টেশনে হতে ২ টি পাশ পারমিট গ্রহণ করেছে মৌয়ালীরা। যা গত ২০২৪ সালের প্রথম দিনেন এক তৃতীয় অংশের চেয়েও অনেক কম।

মধু আহরণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ৪নং কয়রা গ্রামের শহিদ গাইন বলেন, মওসুমের শুরুতে খলিশা ফুলে মধু আসে। খলিশা ফুলের এ মধুটা বিশ্বের কাছে সব চেয়ে বেশি পরিচিত এবং দামও বেশি। এর ২০ থেকে ২৫ দিন পর আসে গরান ফুলের মধু। মওসুমের শেষে আসে কেওড়া, গরান ও ছইলা ফুলের মধু। এই তিন প্রজাতির মধুর মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ও দামি হচ্ছে খলিশার মধু। কারণ, খলিশা ফুলের মধুর মধ্যে কোন পানি বা মিশ্রন থাকে না। মওসুমের প্রথম ফুলের মধু যা একদম খাঁটি। এছাড়া এ বছর এই অঞ্চলে সে রকম বৃষ্টি হয়নি। বৃষ্টি না হওয়ায় ফুল শুকিয়ে ঝরে যায়, তাই মধু জমে কম।

মৌয়ালদের অভিযোগ, আগে বন বিভাগ তিন মাস (এপ্রিল, মে ও জুন) মধু আহরণের অনুমতি দিতো। কিন্তু গত দুই বছর শুধু এপ্রিল ও মে মাসে মধু আহরণ করতে দিচ্ছে। এ ছাড়া সুন্দরবনের প্রায় অর্ধেক এলাকায় মধু আহরণের অনুমতি দেয় না বন বিভাগ। এ কারণে আগের চেয়ে মধু আহরণের পরিমাণ বেশ কমে গেছে বলে জানান তারা।

কয়রা উপজেলার তেতুলতলা গ্রামের মৌয়ালী জামাল ফারুক জানান, গত বছর তাদের দলের প্রত্যেক সদস্য দুই মণ করে মধু পেয়েছিলেন। পাস সংগ্রহ, সরকারি রাজস্ব এবং লোক ও খাওয়া খরচ মিলিয়ে মওসুমে তাদের একেকজনের খরচ হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। আর দুই মণ মধু বিক্রি করে একেকজন পেয়েছিলেন ৪৮ হাজার টাকা। এ বছরও আশানুরূপ মধু পাবেন বলে মনে করছেন তারা। তবে মধু আহরণের জন্য প্রতি বছরে ৫-৭ জন লোক প্রয়োজন কিন্তু এ বছর লোক পাওয়া খুবই সমস্যা হচ্ছে, কারণ সুন্দরবনে বনদস্যু আর বাঘের প্রবণতা বেশি। ফলে ভয়ে এখন আর সুন্দরবনে লোক যেতে চায় না।

মঠবাড়ি গ্রামের রবিউল ইসলাম বলেন, মৌয়ালরা এখনও মহাজনী পদ্ধতিতে টাকা নিয়ে মধু কাটতে যায়। মধু কেটে বাড়ি ফিরে মহজনদের টাকার জন্য অতিরিক্ত মধু দিতে হয়। মধু মওসুমে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে পারলে তারা উপকৃত হতো।

নলিয়ান স্টেশন কর্মকর্তা মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, প্রথম দিনে তেমন একটা পারমিট না হলেও দুই এক দিন পর অনেক মৌয়ালীরা পারমিট নিয়ে মধু কাটতে যাবে সুন্দরবনে। ঈদের জন্য একটু দেরি করে যেতে চাইছে। তবে আশানুরূপ মৌয়াল মধু আহরণ করতে যাবে সুন্দরবনে বলে তিনি আশা করছেন। সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারি বন সংরক্ষক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, এ বছর মৌয়ালদের নিরাপত্তা দিতে বন বিভাগের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যাতে করে তারা যেন কোন প্রকার হয়রানির শিকার না হয়।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১ নবেম্বর সুন্দরবন দস্যুমুক্ত ঘোষণার পর এবারই প্রথম দস্যুদের উপস্থিতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। যা স্থানীয় বনজীবী ও কর্তৃপক্ষকে উদ্বিগ্ন করছে।