২০১৬ সালে বিধিবহির্ভূতভাবে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রে প্রথমবারের মতো চুক্তিভিত্তিক অতিথি প্রযোজক নিয়োগ দিয়েছিল পলাতক শেখ হাসিনা সরকার। তারা হলেন- আফরোজা চৌধুরী, শেখ শওকত ইকবাল, রিফাত মোস্তফা, অরিন্দম মুখার্জি বিংকু, বৈদ্যনাথ অধিকারী, সাখাওয়াত হোসেন মিঠু ও সুমন মজুমদার প্রমুখ। তারা অনুষ্ঠানের নামে ১০ বছরে বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ৫৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা লোপাট করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তারা একটি অনুষ্ঠানে গড়ে ব্যয় করেছেন ৩০ হাজার টাকা। একজন অতিথি প্রযোজক বছরে ২৪০টি অনুষ্ঠান প্রযোজনা করেছেন। সেই হিসেবে ১০ বছরে ২ হাজার ৪শ’ অনুষ্ঠান প্রযোজনা করেছেন প্রতিজন অতিথি প্রযোজক। আটজন অতিথি প্রযোজক ১০ বছরে ১৯ হাজার ২শ‘ অনুষ্ঠান প্রযোজনা করেছেন। এতে ব্যয় করা হয়েছে ৫৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
এসব অতিথি প্রযোজক সরকারের রাজস্ব খাতে স্থায়ী কর্মচারী না হয়েও ৫৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা শিল্পি সম্মানি প্রস্তাবনা ও চুক্তিপত্রে বিধিবহির্ভূতভাবে স্বাক্ষর করে নিজেরাই লোপাট করেছেন। যা কোনোভাবেই আর্থিকবিধি অনুযায়ী হয়নি বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিভি‘র এক কর্মকর্তা। এছাড়া আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত শুধু তাদের বেতন-ভাতাতেই ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা।
২০১৬ সালে তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার জ্যাঁ নেসার ওসমানের সময়ে কোনো বিজ্ঞপ্তি বা নিয়োগ কমিটি ছাড়াই তাদের অতিথি প্রযোজক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। অথচ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিটিভি ঢাকা বা চট্টগ্রাম কেন্দ্রে এ ধরনের তালিকাভুক্ত অতিথি প্রযোজক নিয়োগের নিয়ম ছিল না। নিয়োগপ্রাপ্তদের বেশিরভাগেরই প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অনুষ্ঠান নির্মাণের অভিজ্ঞতা ছিল না। বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের কথা বলে জানা যায়, মূলত অবসরপ্রাপ্ত প্রযোজকদের প্রয়োজনমতো অতিরিক্ত, জটিল অনুষ্ঠান প্রযোজনার জন্যই অতিথি প্রযোজক হিসেবে প্রযোজনা করার এ নিয়ম রাখা হলেও কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে কখনও এ নিয়ম পালন করতে হয়নি।
২০১৬ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অতিথি প্রযোজক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন তারা। ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের অনুষ্ঠান বন্টন আদেশ বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারি প্রযোজকদের অবহেলা করে বড় বাজেটের অনুষ্ঠান এসব অতিথি প্রযোজকদের মাধ্যমে প্রযোজনা করা হতো। ২০২৩ সালের জানুয়ারি প্রান্তিক আদেশে আফরোজা চৌধুরীকে ‘আমাদের সন্তান’, ‘আইন ও অধিকার’, ‘স্বপ্ন আগামীর’,’আমার চট্টলা’, ‘মাহফিল এ কাওয়ালি’, ‘অন্দরে বাহিরে’,’আঁরার চাঁটগা’, ‘ফুল পাখিদের মেলা’, ‘রূপ কথন’ - এ নয়টি অনুষ্ঠানের ৫৪ পর্ব ধারণ দেয়া হয়, যা সরকারি প্রযোজকদের চেয়ে অনেক বেশি। তার নামে সর্বশেষ তিন বছরের নিয়মিত ও বিশেষ অনুষ্ঠান পর্যালোচনা করে জানা যায়, শিশুতোষ আর ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানগুলো ইজারা নিতেন কন্ট্রোলার রোমানা শারমিন, জিএম নিতাই, মাহফুজা ও নূর আনোয়ার হোসেন কাছ থেকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি-মার্চ ও এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে যথাক্রমে শেখ শওকত ইকবালকে প্রতি প্রান্তিকে ৪৮টি, আফরোজা চৌধুরীকে প্রতি প্রান্তিকে ৫৪ ও ৪৮টি, অরিন্দম মুখার্জি বিংকুকে প্রতি প্রান্তিকে ৪৮টি, বৈদ্যনাথ অধিকারীকে প্রতি প্রান্তিকে ৫৪টি, শাখাওয়াত মিঠুকে প্রতি প্রান্তিকে ৪৯টি পর্ব অনুষ্ঠান বন্টন করা হয়। জুলাই -সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে রিফাত মোস্তফাকে ৩৮ পর্ব অনুষ্ঠান দেয়া হয়েছে। ওই সময়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক রাজস্ব খাতের স্থায়ী প্রযোজক থাকা সত্বেও জিএম নূর আনোয়ার হোসেন এবং কন্ট্রোলার রোমানা শারমিন দুর্নীতি করার অভিপ্রায় নিয়ে অনুষ্ঠান বন্টন আদেশে এমন অনিয়ম করেন। এসব বন্টনে বিগ বাজেটের অনুষ্ঠানগুলো এসব অবৈধ অতিথি প্রযোজকদের দেয়া হয়েছে বলে কয়েকজন প্রযোজক জানান। রাজস্ব খাতের এসব সম্মানি পরিশোধ নথি এবং প্রস্তাবনা পত্রে বহিরাগত লোকদের সীল-স্বাক্ষরের বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় হিসাব অফিস অভিযোগ জানালেও অডিটর নবাব হোসেনকে ম্যানেজ করে বিল পাশ করানো হতো।
আফরোজা চৌধুরী প্রযোজিত অনুষ্ঠান ‘ফুল পাখিদের মেলা’ শিশুশিল্পীর অভিভাবক ইউসুফ মিয়া( সিডিডি ৯৭৩৪০৯৬), সঞ্জয় দেয়ানজী (সিডিডি ৮৫২৯৯৯০), মো নাজিম উদ্দীন (সিডিডি ৮৫২৯৯৮৯), মো আজাদুল কামাল( সিডিডি ৮৫২১৭২৩), প্রসেনজিৎ চৌধুরী জীবন (সিডিডি ৬৯২৩৪৯৫) নামের শিল্পী সম্মানি চেক ডেস্কে তালাবদ্ধ করে রাখেন। শিল্পীরা বলছে, তিনি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী শিশু শিল্পীদের সম্মানীর চেক নিজের নামে তুলে নিতেন এবং প্রকৃত শিল্পীদের প্রাপ্য অর্থ প্রদান করতেন না। একাধিক অভিভাবক জানিয়েছেন, টাকা না দেয়ার কারণে তাদের সন্তানরা প্রাপ্য সম্মানী থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
জানা যায়, তথ্য মন্ত্রণালয় প্রেরিত ডিউটিজ অফ চার্টার অনুযায়ী সব নির্মিত অনুষ্ঠান দায়িত্বপ্রাপ্ত কন্ট্রোলারের ছাড়পত্রের ভিত্তিতে সম্প্রচারের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তৎকালীন অনুষ্ঠান শাখার জ্যেষ্ঠ কন্ট্রোলারকে বাদ দিয়ে পান্থ রেজা, নিয়ন্ত্রক(ক্যামেরা), আবদুর রাজ্জাক, উপস্থাপন সম্পাদক, মোহাম্মদ হেমায়েত উদ্দিন উর্ধ্বতন শিল্পনির্দেশককে দিয়ে কমিটি গঠন করে অবৈধ উপায়ে ছাড়পত্র নিয়ে এসব অতিথি প্রযোজকদের অনুষ্ঠান চালানো হতো। যা তথ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশ পরিপন্থী
অতিথি প্রযোজকরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনুষ্ঠান শাখাকে কার্যত নিজেদের অফিসে রূপান্তর করেছিলেন। বিটিভির কর্মকর্তারা ছিল তাদের কাছে অসহায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিল্পী জানান, এসব লুটপাট, দুর্নীতির বিচার চেয়ে অতিথি প্রযোজক, রোমানা শারমিন এবং নূর আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ করা হয়েছে। জাসাস নেতা মামুনুর রশিদ শিপন বলেন, “অতিথি প্রযোজকদের নিয়োগ একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ছিল। তারা ছিলেন অযোগ্য, অদক্ষ এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। সরকারের উচিত অনিয়মে লোপাট হওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়া।”
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বিটিভি সদরদপ্তর, কেন্দ্র প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা চট্টগ্রাম কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বিবেচনায় নিয়ে বিধিবর্হিভূত অতিথি প্রযোজকসহ বিশ জনকে বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে কাজ এবং প্রবেশ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। ফলে গত বছরের সেপ্টেম্বরে এদের ছাঁটাই করা হয়। ফ্যাসিস্টের এসব দোসর পুনঃনিয়োগের জন্য জোর তদবির চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বর্তমান জেনারেল ম্যানেজার ঈমাম হোসাইন ফোন রিসিভ করেননি।