গাজীপুরের চন্দনা চৌরাস্তা এলাকায় আলোচিত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যাকাণ্ডের রহস্য একের পর এক উন্মোচিত হচ্ছে। গতকাল সোমবার মামলার অন্যতম আসামী শাহজালাল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। এতে উঠে এসেছে মাদক সেবনের আসর থেকে শুরু করে মুহূর্তের মধ্যে ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডে রূপ নেওয়া এক রাতের বিবরণ।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ জাহিদুল হাসান জানান, সাংবাদিক তুহিন হত্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়া ৮ আসামীকে রিমান্ড শেষে সোমবার আদালতে তোলা হয়। এ সময় আসামী শাহজালাল লোমহর্ষক স্বীকারোক্তি দিয়ে হত্যার বিস্তারিত তুলে ধরেন।

শাহ জালাল আদালতে বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ইয়াবা ব্যবসা ও “ঠেক” দিয়ে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। ৭ আগস্ট রাতে তিনি, মিজান, স্বাধীন, সুমন, আরমান, ফয়সাল ও আলামিন মিলে ইয়াবা সেবন করছিলেন। রাতের এক পর্যায়ে মিজানের স্ত্রী গোলাপী ফোন করে জানায়, শাপলা মেনশনের কাছে “ফিটিং” দিয়ে টাকা-পয়সা নেওয়ার মতো একজন লোক পাওয়া গেছে।

চাপাতি, দা ও সুইচগিয়ার চাকু হাতে নিয়ে তারা শাপলা মেনশনের দিকে যায় এবং গোলাপীকে ঐ ব্যক্তির সঙ্গে হাতাহাতিতে লিপ্ত দেখতে পায়। মুহূর্তেই তারা ঐ ব্যক্তিকে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে। আহত ব্যক্তি একটি মুদি দোকানে ঢুকে পড়লে গোলাপী চিৎকার করে বলে ওঠে “তুহিন সাংবাদিক ভিডিও করছে।”

এই কথা শোনামাত্র তারা হামলার লক্ষ্য পরিবর্তন করে তুহিনের দিকে ধেয়ে যায়। চায়ের দোকানের সামনে প্রথমে মিজান দা দিয়ে তুহিনকে আঘাত করে। তুহিন দোকানের ভিতরে ঢুকে পড়লেও স্বাধীন, সুমন, আরমান, আলামিন ও ফয়সাল মিলে তাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এ সময় মিজান তুহিনের মোবাইল ফোন নিয়ে নেয়। গোলাপীর “পুলিশ আসছে” চিৎকার শোনার পর সবাই দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (ক্রাইম-উত্তর) মোঃ রবিউল ইসলাম জানান, “পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। একজন আসামী আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, ভিডিও ও ছবি ফরেনসিক পরীক্ষায় পাঠানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তদন্তে কোনো রাজনৈতিক বা শক্তিশালী গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলেনি। আমরা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলার চার্জসিট দিতে পারব”

অন্যদিকে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সোমবার গাজীপুর প্রেসক্লাবে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে -এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে শক্তিশালী গোষ্ঠীর ইন্ধন রয়েছে। সংগঠনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব আলহাজ্ব মাওলানা আতাউর রহমান বলেন, “তুহিনকে শুধুমাত্র ভিডিও ধারণের জন্য হত্যা করা হয়নি; এর পেছনে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র আছে। গ্রেফতার হওয়া কেউ স্থানীয় নয়, তাহলে আশ্রয়দাতারা কারা?

মাওলানা আতাউর রহমান আরও বলেন, “গাজীপুরে কারা এই সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করছে, যারা হত্যা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই চালিয়ে যাচ্ছে- তাদের চিহ্নিত করতে হবে।” দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বেগ জানিয়ে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) বজায় থাকবে কিনা তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে।

তিনি অভিযোগ করেন, গাজীপুরে প্রতিনিয়ত খুন, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সন্ত্রাসীরা এখানে আশ্রয় নিচ্ছে, অথচ তাদের বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বিশাল জনগোষ্ঠীর এই শহরে পুলিশের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল উল্লেখ করে তিনি অবিলম্বে পুলিশ সংখ্যা বৃদ্ধি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের জোর দাবি জানান।

প্রেস ব্রিফিংয়ে বক্তারা সাংবাদিক হত্যা মামলার দ্রুত তদন্ত, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন। তারা সতর্ক করে বলেন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও জনগণের জানার অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এছাড়া সংবাদ সম্মেলনের তিনি সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেউ নিহত সাংবাদিক তুহিনের পরিবারের পাশে দাঁড়ায়নি বলে দুঃখ প্রকাশ করে। এছাড়া নিহত সাংবাদিক তুহিনের পরিবারের দায়িত্ব সরকারকে নেয়ার আহ্বান জানান

পুলিশ বলছে- কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ নেই, আর রাজনৈতিক পক্ষ দাবি করছে, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ছায়া রয়েছে। দুই বিপরীত বক্তব্য জনমনে প্রশ্ন তুলেছে তদন্তের শেষ মুহূর্তে কি কোনো নতুন চমক অপেক্ষা করছে?