ছেলে তারেক রহমানের নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বার বার চোখ মুছছিলেন পিতা আবু তালেব মিয়া। তারেক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক জানা সত্ত্বেও তাকে মারতেও দ্বিধাবোধ করেননি সেদিন পুলিশসহ যৌথবাহিনীর সদস্যরা। একাধিকবার নির্মম নির্যাতন করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে ভর্তি করে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে এক নম্বর আসামী করা হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের খুলনার প্রথম সারির নেতা মুহাম্মদ তারেক রহমানকে।
গতকাল বৃহস্পতিবার খুলনা প্রেসক্লাবের হুমায়ুন কবীর বালু মিলনায়তনে সাংবাদিক সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া সমন্বয়ক তারেক রহমান যৌথবাহিনীর হাতে অমানুষিক নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, গত ৩ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) রাত ১২টার পর নগরীর ৫নং ঘাট এলাকায় ডিবি পুলিশের সাথে স্থানীয় শ্রমিকদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এ ঘটনায় শুক্রবার ভোর ৪টার দিকে যৌথ বাহিনী, ডিবি ও থানা পুলিশ তাদের বাসায় যৌথ অভিযান চালায়। তার পিতা ২১ নং ওয়ার্ড শ্রমিক দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করায় তাকে খুঁজতে থাকে। তাকে না পেয়ে তারেক এবং তার ভাগ্নেকে ধরে মারধোর করতে থাকে। সে সমন্বয়ক জানতে পেরে অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে। এ সময়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের তারেক রহমান জানান, পরে তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার এক পর্যায়ে ৬ এপ্রিল হাজির করা হলে সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন। সে এখনও ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার ওপর নির্যাতনের ছবিই প্রমাণ করবে কতটা অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে।
সাংবাদিক সম্মেলনের পর বৃহস্পতিবার দুপুরে ৫ নং ঘাট এলাকায় গিয়ে বিভিন্নজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২ টার দিকে ৪ নং ঘাট খাদ্য গুদাম হেল্ডিং শ্রমিক ইউনিয়নের ক্যাশিয়ার এবাদুল ও তার বন্ধু কালাম মোটরসাইকেলযোগে মামার মাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে এবাদুলের বন্ধু কালাম মামার মাজারের সামনে নেমে গিয়ে বন্ধুকে সামনের দিকে যেতে নিষেধ করেন। কিন্তু তার কথায় কর্ণপাত না করেই সামনের দিকে এগুতে থাকে এবাদুল। মামুর মাজারের সামনে গেলেই পুলিশের প্রশ্নের সম্মুখীন হন এবাদুল। এক পর্যায়ে পুলিশের হাতে প্রহৃত হয় এবাদুল। দু’টো দাঁত ফেলে দেয় ডিবি পুলিশ। এরই মধ্যে ফোন করে শ্রমিক নেতা এবাদুল তার সহযোগীদের মামুর মাজারের সামনে জড়ো করে। শুরু হয় শ্রমিক এবং পুলিশের মাঝে বাক বিতন্ডা। এক সময়ে বাড়ি থেকে ডেকে নেওয়া হয় ৪ নং ঘাট খাদ্য গুদাম হেল্ডিং শ্রমিক ইউনিয়নের আহবায়ক আবু তালেব মিয়াকে। সেখানে উপস্থিত হয়ে তিনি ঘটনার মীমাংসা করে দেয়। এরপর তিনি বাড়িতে ফিরে যান। এর কিছুক্ষণ পরেই তিনি জানতে পারেন বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালাবে। সংবাদ পেয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। ঘড়ির কাটা যখন ২ টা ছুইছুই। সেই মুহুর্তে আবু তালেব মিয়ার খোঁজে বাড়িতে মহানগর গোয়েন্দা, খুলনা সদর থানা পুলিশ এবং নৌথবাহিনীর সদস্যদের পদাচারণায় আশপাশের বাড়ির মানুষের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন রাস্তায় জড়ো হতে থাকে আবু তালেবের প্রতিবেশীরা। রাতে যৌথবাহিনীর সদস্যরা আবু তালেবের ঘরে প্রবেশ করে তাকে না পেয়ে নাতি হৃদয়কে টেনে হেচড়ে বের করে আনে। হৃদয়কে মারতে থাকে। তার চিৎকার সহ্য করতে না পেরে মা ও নানী ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে আসেন। তাদেরকে হৃদয়ের কাছে সেদিন রাতে যেতে দেয়নি যৌথবাহিনীর সদস্যরা। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। চিৎকার শুনতে পেয়ে মামা তারেক রহমান ঘর থেকে বের হয়ে আসলে তাকেও ছাড় দেয়নি যৌথবাহিনীর সদস্যরা। সমন্বয়ক পরিচয় জেনেও নির্মম নির্যাতন চালানো হয় তার ওপর।
তারেক রহমানের পিতা আবু তালেব বলেন, সেদিন রাতে পুলিশ ও শ্রমিকের মধ্যকার দ্বন্ধ মিটিয়ে দিয়ে বাড়িতে ফিরে আসি। তাদের সাথে তার বা পরিবারের কোন দ্বন্ধ নেই। তার ছেলে তারেক রহমান খুলনার সরকারি আযমখান কমার্স কলেজ ছাত্রশিবিবের সভাপতির দায়িত্বে পালন করছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে ছেলে তারেক সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছে। ওই দিন রাতের ঘটনা ছেলে তারেক এবং নাতি হৃদয় জানেনা। রাতে বাড়িতে অভিযান চালিয়ে যৌথবাহিনীর সদস্যরা তাকে অমানুষিক নির্যাতন করে। তার ৬০ বছরের বয়সে এ রকম নির্যাতন করতে কাউকে দেখেনি। তারেক ছাত্র সমন্বয়ক এটা জানে খুলনা সদর থানার এস আই নান্নু মন্ডল। তারেকের পরিচয় জানার সাথে সাথে তার ওপর নির্যাতন চলে আরও বেশি। তার সন্তান এবং নাতি কোন অপরাধী নয়। যদি তার নামে কোন দুর্নাম থাকে তাহলে আপনারা খোঁজ নেন। কোন দুর্নাম থাকলে ছেলেকে কুরবানি দিয়ে দিব। তাদের কেন এমন নির্দয়ভাবে মারল প্রশাসন এর বিচার তিনি সরকার প্রধানের কাছে চেয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী হালিমা খাতুন জানান, ঘটনার সময় ৫ নং ঘাটের বউ বাজারে তিনি দাড়িয়ে ছিলেন। এ সময় এবাদুল এবং কালাম টাকা নিয়ে তর্ক বিতর্ক করতে থাকে। এবাদুল একটু সামনে গেলে তাকে গোয়েন্দা পুলিশ প্রশ্ন করতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ এবাদুলের কাছে মোটরসাইকেলের কাগজপত্র দেখতে চায়। কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হলে পুলিশ এবাদুলকে মারতে উদ্যত হয়। সে সময় এবাদুল ছুটে গিয়ে আবু তালেবের বাড়িতে যান এবং তাকে সেখানে ডেকে নিয়ে আসে। মামা (আবু তালেব) বিষয়টি মীমাংশা করে দিয়ে বাড়িতে ফিরে যান। রাত ২ টার পর যৌথবাহিনী তার বাড়িতে গিয়ে খুজে না পেয়ে ছেলে তারেক এবং তার নাতী হৃদয়কে অমানষিক মারধর করতে থাকে। তাদের মার দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি তিনি। তার প্রশ্ন এরা কোন অপরাধ করেনি। তাহলে তাদের ওপর এমন নির্যাতন করা হল কেন? । এর বিচার চান তিনি।
খুলনা সদর থানার সেকেন্ড অফিসার এস আই নান্নু মন্ডল বলেন, ডিবি পুলিশের উপর হামলা হয়েছে। তারাই মামলা করেছেন এবং তারাই তদন্ত করছেন। তিনি তারেক রহমানকে চেনেন না। কখনও তার সাথে কথা হয়নি। দেখলেও চিনবেন না। তাকে জড়িয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে যে অভিযোগ করা হয়েছে তার সাথে তিনি সম্পৃক্ত নই বলে দাবি করেন। যদিও এ ব্যাপারে খুলনা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ও কেএমপির খুলনা থানায় দায়েরকৃত ৪ এপ্রিলের ৫ নম্বর মামলার বাদী মো. এবাদ আলী বলেন, ঘটনার সময় মুহাম্মদ তারেক রহমান ও অন্যান্যরা ছিলেন। সেখানে তাদের হামলায় বেশ কয়েকজন পুলিশ আহত হন। যাদের খুলনা জেনারেল হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার জানান, তিনি নিজে সাদা পোশাকে গিয়ে ঘটনা তদন্ত করেছেন। সেখানে তারেক রহমানের সম্পৃক্ততার তথ্য পেয়েছেন।