শামছুল আলম সেলিম : কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদকে ঘিরে রয়েছে মানুষের কুসংস্কার ও অজ্ঞতা। বর্তমানে সুযোগ সন্ধানী দু’একজন ইউটিউবারের ডিজিটাল প্রচারনায় তা বাড়তি মাত্রা পেয়েছে। আলেমরা বলছেন, মসজিদে দান করা ভালো কাজ, উত্তম আমল। তবে ভুল আকীতা-বিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে মানুষকে বের করে আনতে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ও বুঝ দান করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রশাসন ও আলেম সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।

মসনদে আলা ঈসাখাঁর স্মৃতি বিজড়িত কিশোরগঞ্জ জেলায় প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপত্যের বিখ্যাত নানা দর্শনীয় স্থান রয়েছে। প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদ বর্তমানে দেশ-বিদেশে ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থাপনা হিসেবে খ্যাত। মসজিদটি শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছেই নয়, সকল ধর্মাবলম্বীদের নিকট অত্যন্ত পবিত্র ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

মসজিদ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

মসনদে আলা ঈসাখাঁর বংশধরদের বাসস্থান কিশোরগঞ্জ শহরের হয়বতনগর দেওয়ান বাড়ি। দেওয়ান হয়বত খান হয়বতনগর দেওয়ান বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা। হয়বতনগর দেওয়ান বাড়ির দেওয়ানদের তথ্যমতে, কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের হয়বতনগর এলাকার প্রতিষ্ঠাতা দেওয়ান হয়বত খানের অধীনস্ত নবম পুরুষ দেওয়ান জোলকদর খান ছিলেন সুফীসাধক। তার কামেলিয়াতের খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ আসা শুরু হয়। তখন মসজিদ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়। দেওয়ান জোলকদর খান একদিন স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে দেওয়ানবাড়ির অদূরে ঐতিহাসিক নরসুন্দা নদীর তীরে এই পাগলা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।

পাগলা মসজিদ নামকরণ কেন

মানুষ জোলকদর খানকে (আল্লাহর দেওয়ানা) পাগল বলে ডাকতো। মানুষের মুখে মুখে পাগলা মসজিদ নামে খ্যাতিলাভ করল।

মসজিদের বিবরণ

প্রতিষ্ঠার সময় মসজিদের ভূমির পরিমাণ ১০ শতাংশ থাকলেও, এখন তা সম্প্রসারিত হয়ে এর মোট ভূমির পরিমাণ প্রায় ৩ একর ৮৮ শতাংশ।

বর্তমানে তিন তলা বিশিষ্ট পাগলা মসজিদের ছাদে তিনটি বড় গম্বুজ এবং ৫ তলা ভবনের সমান একটি মিনার রয়েছে। সহস্রাধিক মুসল্লির ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই মসজিদ।

পাগলা মসজিদের ইমরাত খুবই সুন্দর এবং নির্মাণশৈলীও বেশ চমৎকার। আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত পাগলা মসজিদটি নানা ধরণের ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থাপনা হিসেবে খ্যাত। বর্তমানে লেকসিটি প্রকল্পের আওতায় পাগলা মসজিদের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নরসুন্দা নদী খনন, দৃষ্টিনন্দন সেতু নির্মাণ, মসজিদের শোভাবর্ধন এবং রঙিন আলোকসজ্জার জন্য দিনে ও রাতে মসজিদটি দেখতে চমৎকার লাগে। দেশের দূরদূরান্ত থেকে নানা শ্রেণী পেশার মানুষ মসজিদটি দেখতে ভিড় জমান। বিশেষত জুমার নামাজের সময় অত্যাধিক মানুষের সমাগমে মসজিদ পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

এ মসজিদে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও নামাজ আদায়ের সুব্যবস্থা রয়েছে। নারীরা মসজিদের পৃথক স্থানে নামাজ আদায় করেন। মসজিদে যারা আসেন সবাই দু’হাত খুলে দান করেন। শুধু মুসলমান নয়, অন্যান্য ধর্মের লোকজনকেও এ মসজিদে দান করতে দেখা যায়। এটি দেশের অন্যতম বিত্তশালী মসজিদ।

দেশজুড়ে পরিচিতির কারণ

বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাগলা মসজিদ সকল ধর্মের মানুষের কাছে এক পবিত্র ধর্মীয় কেন্দ্র। এই

দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এসে পাগল খুঁজে। কিন্তু পাগলা মসজিদে কোন পাগল নেই। নেই কোন মাজার। আশেপাশের কোথাও পাগলের বসতিও নেই। পাগলা মসজিদের সেই পাগলা বাবা নিয়ে আবার এক ধরনের ডিজিটাল প্রচারণা শুরু হয়েছে। শুক্রবারে মসজিদের আশেপাশে কিছু পাগল পাগলির আগমন ঘটে।

পাগলা মসজিদ নাম শুনলেই বর্তমানে চোখে ভেসে ওঠে মসজিদের দানবাক্স খুললেই দেখা মেলে কোটি কোটি টাকা, বৈদেশিক মূদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার। এ মসজিদকে ঘিরে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। এই মসজিদে মানত কিংবা দান খয়রাত করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়- এমন বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন বয়সী হিন্দু-মুসলিমসহ নানা ধর্ম-বর্ণের নারী-পুরুষ মানত নিয়ে এখানে আসেন। তারা নগদ টাকা-পয়সা, স্বর্ণ ও রুপার অলংকারের পাশাপাশি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি দান করেন। বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার এ মসজিদে মানত নিয়ে আসা বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের ঢল নামে। দেশের মানুষের মাঝেও রয়েছে নানা কৌতুহল। মানুষের বিশ্বাস, কোনও আশা নিয়ে একনিষ্ঠ মনে এ মসজিদে দান করলে আল্লাহ তা কবুল করেন। রোগ-শোক ছাড়াও বিভিন্ন উপলক্ষে মানুষজন এ মসজিদে মানত করে দান করেন। যুগ যুগ ধরে এ বিশ্বাস থেকেই মানুষ মসজিদটিতে দান করছেন।

মানুষের আরও বিশ্বাস এই মসজিদ পাগলা মসজিদ, গরম মসজিদ। এ মসজিদে দান করলে মনোবাঞ্ছনা পূরণ হবেই, কখনো বিফলে যাবে না। এই বিশ্বাস থেকেই মানত মানা হয়। দুই ব্যক্তি ঝগড়া লাগলেও সুবিচার পাওয়ার জন্য পাগলা মসজিদে দানের মানত মানে। কিছু হারিয়ে গেলেও পাওয়ার আশায় মানত মানে। সন্তান পাওয়ার আশায়, বিয়ে-শাদী হওয়ার আশায়,চাকুরী পাওয়ার আশায় দান করে থাকে। লিখিত চিঠি ও পাওয়া যায়। এবার একটি চিঠিতে একজন লিখেছেন, আল্লাহ জামায়াত ইসলামী কে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করো। সকল ধর্মের মানুষ প্রতিনিয়ত মানতের নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার, বৈদেশিক মুদ্রা, গরু-ছাগল, হাস-মুরগীসহ মানতের বিভিন্ন সামগ্রী দান করে থাকেন। তাই প্রতিমাসে শুধু দানের নগদ অর্থ আর বিভিন্ন দানসামগ্রী থেকেই এ মসজিদের আয় হয় কোটি কোটি টাকা।

কারা দেন এসব টাকা,

প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে প্রচুর লোক সমাগম হয়। সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় সেদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বেশি বেশি দান খয়রাত করে থাকে। এছাড়াও প্রতিদিনই মানুষ আসে, দান করার দৃশ্য চোখে পড়ে। প্রতি তিন মাস পর পর খোলা হয় এই মসজিদের ১১টি লোহার দানসিন্ধুক।

মসজিদের দানসিন্ধুকগুলো খুলতেই দেখা যায় শুধু টাকা আর টাকা। এসব টাকা বস্তায় ভরে নেয়া হয় ঐ মসজিদের দোতলায়। পরে, মসজিদের মেঝেতে বসে দিনব্যাপী টাকা গণনার কাজে অংশ নেয় মসজিদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত মাদরাসা ও এতিমখানার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, পার্শ্ববর্তী জামিয়া এমদাদিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থী, রূপালী ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মাচারীসহ চার শতাধিক মানুষের একটি দল। এসময় উপস্থিতি থাকেন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও পুলিশ সুপার ।

কি হয় দানের টাকায় ?

ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের অ্যাকাউন্টে জমা রয়েছে মোট ৮০ কোটি ৭৫ লাখ ৭৩ হাজার ৫৭৬ টাকা।

গণনা শেষে মসজিদের ব্যাংক হিসাব নম্বরে টাকা জমা রাখতে সম্পূর্ণ পুলিশি নিরাপওায় দানের সব টাকা নিয়ে যাওয়া হয় ব্যাংকে। এছাড়াও মসাজিদে মানতের বিভিন্ন দানসামগ্রীগুলো প্রতিদিন আসরের নামাজের পর প্রকাশ্য নিলাম ডাকের মাধম্যে বিক্রয় করে প্রাপ্ত অর্থ পরদিন ব্যাংক আওয়ারে মসজিদের হিসাব নম্বরে জমা রাখা হয়। যা পরে প্রতিমাসে ব্যায় করা হয় কর্মচারীদের বেতন ভাতা ও মসজিদের বিভিন্ন রক্ষনাবেক্ষণের কাজে।

পাগলা মসজিদের টাকায় ২০০০ সালে মসজিদের পাশেই একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বর্তমানে এই মাদ্রাসায় ১৩০ জন এতিম শিশু পড়াশোনা করছে। মসজিদের টাকায় তাদের যাবতীয় ভরণপোষণ করা হয়ে থাকে।মসজিদের ব্যাংক হিসাব নম্বরে জমা রাখা দানের টাকা থেকে আশা লভ্যাংশ ব্যয় করা হয়, দুস্থ ও দূরারোগ্য রোগীদের মাঝে। এছাড়া মসজিদের মূল তহবিলের টাকা এখন আর কোথাও ব্যয় করা হচ্ছেনা বলেই জানিয়েছেন মসজিদ কতৃপক্ষ। প্রতি অর্থবছর ওয়াকফ স্টেটের অডিটর দ্বারা মসজিদের আয়-ব্যয়ের অডিট করা হয়। সবশেষ মসজিদের দানসিন্ধুক খুলে রের্কড পরিমান টাকা পাওয়া যায়। যা অন্যান্যবারের সকল রের্কড ভেঙ্গে তৈরি করেছে নতুন রের্কড। সর্বশেষ চলতি বছরের ১০ এপ্রিল গণনা শেষে ৯ কোটি ১৭ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। যা অতীতের সব রের্কড ছাড়িয়েছে।

মসজিদের সভাপতির বক্তব্য

ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের সভাপতি ও কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান বলেন - মসজিদের দানের টাকায় আন্তর্জাতিক মানের একটি দৃষ্টিনন্দন ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। যেটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে অন্যতম স্থাপত্য হিসেবে নির্মিত হবে। এজন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ থেকে ১২০ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক মানের এ কমপ্লেক্সটি নির্মিত হলে একসঙ্গে প্রায় ৩৫ হাজার মুসুল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। সেই সাথে ৫ হাজার নারীর নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা ব্যবস্থাসহ মুসুল্লিদের ২০০ গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে।

নাগরিক ভাবনা

এ মসজিদে দান করলে মনোবাঞ্ছনা পূরণ হয়, এই বিশ্বাস থেকেই মানত মানা হয়। কতিপয় আলেম মনে করেন, এই ধরনের বিশ্বাস ও চিন্তা কুসংস্কারের অংশ ও শরিয়তবিরোধী। পাগলা মসজিদে মানতের টাকা দান করার কোন সুযোগ নেই। মানতের টাকার হকদার এতিমরা, মসজিদ নয়। মানতের টাকা মসজিদে ব্যবহার করা যাবে না। কিশোরগঞ্জের অন্যতম বৃহত্তম মাদ্রাসা হয়বতনগর কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওঃ আজিজুল হক বলেন, বর্তমানের পাগলা মসজিদের বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

এজন্যে টেকনিকাল কলেজ, মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে গরিব ও মেধাবী ছাত্রদেরকে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

কিশোরগঞ্জের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক মোঃ মোসলেহ উদ্দিন বলেন ধর্মীয় জ্ঞানহীনরাই পাগলা মসজিদে পাগলের মত টাকা দান করে! এই দানে সোয়াবের চেয়ে গুনাহের সম্ভাবনাই বেশি। মসজিদে হারাম মসজিদুন নববী এবং মসজিদে আকসা ছাড়া পৃথিবীর সকল মসজিদের মর্যাদা সমান।

মসজিদের দান মসজিদের প্রয়োজনেই হওয়া উচিত। তাই আপনার পাড়াপড়শির মসজিদের দিকে নজর দিন। সুযোগ থাকলে সেটির উন্নয়নে অংশগ্রহণ করুন। বিশেষ কোনো ধনী মসজিদকে আরো ধনী বানানোর দরকার নেই।

কিভাবে যাওয়া যায়

দেশ-বিদেশ থেকে কিশোরগঞ্জ শহরে আসতে হবে। পরে রিক্সাযোগে বা পায়ে হেঁটে শহরের পশ্চিম প্রান্তে হারুয়া এলাকায় অবস্থিত পাগলা মসজিদে যেতে হবে।