বছরে ৬ মাস পানিবন্দী থাকে বিলডাকাতিয়া। হামকুড়া ও শৈলমারী নদী মারা যাওয়ায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে বিলটিসহ ডুমুরিয়ার উত্তরাঞ্চল। যা বর্তমানে স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে। একটা সময় কৃষিজীবী মানুষের আশীর্বাদ ছিলো, আজ তা অভিশাপে পরিণত হয়েছে। তিন মাসের বেশি সময় ধরে পানিবন্দী জীবন-যাপন করছেন এ অঞ্চলের মানুষ। দীর্ঘ জলাবদ্ধতার কারণে খুলনা অঞ্চলের লাখো মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে মানুষ।
এদিকে নদী খননের প্রকল্প অনুমোদনেও দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিয়েছে। আগামী কতো বছর জলাবদ্ধতা থাকবে তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে পানিবন্দী মানুষের মাঝে। বিলডাকাতিয়াসহ ডুমুরিয়া উপজেলার উত্তরাঞ্চলীয় এলাকার পানি ২টি পথে নিষ্কাশিত হতো। এর একটি ছিলো হামকুড়া নদী হয়ে ঘ্যাংরাইল দিয়ে, অপরদিক শৈলমারী নদী হয়ে কাজিবাছা ও শিবসা হয়ে। প্রবাহমান হামকুড়া নদীর জলধারা আরও গতিশীল করতে এবং বিলডাকাতিয়ার নিচু এলাকা উঁচু করার লক্ষ্যে জনগণ ১৯৯০ সালে সন্ধ্যার খাল নামকস্থানে দৌলতপুর-চুকনগর সড়ক কেটে দিয়ে বিলডাকাতিয়ায় জোয়ার-আধার চালু করে। এর ৩ বছরের মাথায় ১৯৯৩ সালে তৎকালীন সাবেক এমপি মরহুম সালাউদ্দিন ইউসুফ ও মরহুম গাজী আব্দুল হাদীর নেতৃত্বে সন্ধ্যার খালে পুনরায় বাঁধ দেয়া হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে আমকুড়া নদী নিস্তেজ হতে থাকে। বর্তমান নদীটি মানচিত্র থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে।
এদিকে পানি নিষ্কাশনের একমাত্র শৈলমারী নদীটিও বর্তমানে পলি পড়ে প্রায় সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। গত ৫ বছর এ নদীর নাব্যতা আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। যার কারণে প্রতিবছর বর্ষা মওসুমে বিলডাকাতিয়ায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। বছরে ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে জলমগ্ন অবস্থায় থাকতে হচ্ছে লাখো মানুষের।
ভৌগোলিক দিক দিয়ে বিলডাকাতিয়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল। একটা সময় কৃষিজীবী মানুষের আশীর্বাদ থাকলেও বর্তমানে তা অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে বিলডাকাতিয়াসহ ডুমুরিয়া সদর, রংপুর, রুদাঘরা, রঘুনাথপুর, ধামালিয়া, গুটুদিয়া, ফুলতলা, দামোদর, জামিরা ও শিরোমনি ইউনিয়নের প্রায় ৩১টি গ্রামসহ ছোট বড় ১৭টি বিলের অন্তত ৩০/৩৫ হাজার হেক্টর আবাদি জমি।
জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৩৫ কিউসেক ক্ষমতা সম্পন্ন ২টি সাব মার্সিবল পাম্প স্থাপন করে শৈলমারী ১০ ভেন্ট রেগুলেটরের উপর। গত জুন মাসের ২ তারিখ থেকে পাম্প চালু করা হয়। তাছাড়া বর্ষা মওসুমের মাঝামাঝি সময় এসে গেটের মুখ থেকে শুরু করে সালতা পর্যন্ত খনন কার্যক্রম শুরু হয়। ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বরাদ্দে আপদকালীন এ খনন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এত কিছুর পরেও ঘর থেকে কেবল উঠানে নেমেছে পানি। উপজেলা প্রশাসন ও বিএডিসি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে, কিভাবে পানি নিষ্কাশন করা যায় সেই লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু সম্পূর্ণ পানি নামতে আরো ৩ মাস সময় লাগবে বলে মনে করছেন পানিবন্দী মানুষ।
এদিকে শৈলমারী নদী খননের জন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের একটি প্রকল্প অনুমোদন নিয়েও নানা জঠিলতা শুরু হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রস্তাব আকারে যে প্রকল্পটি মন্ত্রণালয় দিয়েছে সে অনুযায়ী কাজ হলে খননের ৬ মাসের মধ্যেই পলিপড়ে ভরাট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যার ফলে পরিবেশ অধিদপ্তরে প্রকল্পের ফাইলটি আটকে আছে দীর্ঘদিন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর শৈলমারী নদী এলাকায় স্থানীয় জনসাধারণের সাথে শৈলমারী নদী খননের সুবিধা ও অসুবিধার বিষয় পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের উপর এক মতবিনিময় সভা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। সেখানে উপস্থিত জনসাধারণ শৈলমারী নদীর সাথে কাজিবাছার সংযোগ রাখার জন্য জোর দাবি জানান। বোরো মওসুমও আসন্ন। কৃষক যদি বিলে ধান উৎপাদন না করতে পারে তা হলে, না খেয়ে থাকতে হবে তাদের। এমনটা মনে করছেন অধিকাংশ খেটে খাওয়া মানুষগুলো।
কৃষ্ণনগর এলাকার জয়ন্ত মন্ডল জানান, ২০১৬ সালের আগে বিল ডাকাতিয়াবাসী ভালো ছিলো। ২০২৩ সাল থেকে সেই ভয়াবহ দিন চলে এসেছে। তাদের সুখের দিন আর বেশিদিন গেলো না।
স্থানীয় বাসিন্দা তপন মন্ডল জানান, জোয়ার-ভাটা যখন ছিলো তখন বিলডাকাতিয়াবাসী ভালো ছিল। তারা পুনরায় জোয়ার-ভাটা চালু করার দাবি জানান। স্থানীয় কমলেশ মন্ডল জানান, তার বাবার ১২ বিঘা বিলান সম্পত্তি রয়েছে। কিন্তু গত ৩ বছর জমিতে কিছুই হয়না। আর্থিক কষ্টের মধ্যে দুধ বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।
এদিকে দীর্ঘ পানিবন্দীর কারণে চর্মরোগসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষের জীবনকে আরো দূর্বিসহ করে তুলছে। ডুমুরিয়া উপজেলা পানি কমিটির সভাপতি সহকারি অধ্যাপক জিএম আমান উল্লাহ জানান, ৯০ এর কাটিং পয়েন্ট সন্ধ্যার খালে যদি বাঁধ না দেয়া হতো তা হলে বিলডাকাতিয়ার বৃহৎ অংশ পলিতে ভরাট হয়ে উঁচু হতো এবং আবাদি জমিগুলো অজন্মা হতো না। হামকুড়া নদী, হরি নদী থেকে শুরু করে ভাটি অঞ্চলের সকল নদীগুলো আজ জীবিত থাকতো। তিনি পুনরায় এ অঞ্চলে জোয়ার-ভাটা (টিআরএম) বাস্তবায়নের দাবি জানান। এ ব্যাপারে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জল কুমার সেন জানান, শৈলমারী নদীসহ অনেকগুলো খাল পুন:খননের জন্য ৪৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প দেয়া হয়েছে। এখনো তা বাস্তবায়ন হওয়ার অনেক দেরি।