গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১৩ মাসে চট্টগ্রাম শহর ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় খুন হয়েছেন অন্তত ৩৫ জন। এর মধ্যে গুলীতে নিহত হয়েছেন ২৪ জন। বাকিদের পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, এসব হত্যার বেশিরভাগ ঘটেছে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমি দখল ও এলাকা দখল নিয়ে আধিপত্য বিস্তারের জেরে।
নগরে ও গ্রামে রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব: চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় এ সময়ে খুন হয়েছেন ৪ জন, রাউজানে ১৭ জন, রাঙ্গুনিয়ায় ১৪ জন এবং ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড ও মীরসরাইয়ে একজন করে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিলেও হত্যার ধারাবাহিকতা থামেনি। কোনো ক্ষেত্রে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে, আবার কোথাও জড়িতদের বহিষ্কার করা হয়েছে। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর পুরাতন চান্দগাঁও এলাকায় খেলার মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে যুবদলের দুই গ্রুপে সংঘর্ষে ছুরিকাঘাতে নিহত হন জুবায়ের উদ্দীন বাবু (২৫)। ১১ অক্টোবর রাতে বায়েজিদ বোস্তামি এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ইমন (২৮) নামের এক যুবক খুন হন। ২৫ অক্টোবর বাকলিয়ায় দুই পক্ষের গোলাগুলীতে প্রাণ হারান ছাত্রদল কর্মী মো. সাজ্জাদ।
এছাড়া ২১ মার্চ খুলশী এলাকায় ব্যানার টানানোকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলীবিদ্ধ হন মো. জিহাদ; পরে ৩ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এসব ঘটনার পেছনে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকেই দায়ী করছে পুলিশ।
রাউজানে একের পর এক হত্যাকাণ্ড: রাউজান উপজেলায় হত্যাকাণ্ড যেন নিত্যঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের ২৮ আগস্ট থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত অন্তত ১৭ জনকে খুন করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমকে গুলী করে হত্যা করা হয়। ফেব্রুয়ারিতে পিটিয়ে মারা হয় মুহাম্মদ হাসানকে। ১৫ মার্চ ছুরিকাঘাতে নিহত হন কমরউদ্দিন জিতু, ২১ মার্চ পিটিয়ে মারা হয় মো. রুবেলকে, ৪ এপ্রিল প্রকৌশলী নূর আলম বকুল খুন হন। ১৯ এপ্রিল গুলি ও চাপাতির আঘাতে হত্যা করা হয় আবদুল্লাহ মানিককে, ২২ এপ্রিল দোকানে ডেকে এনে মাথায় গুলী করে খুন করা হয় ইব্রাহিমকে।
৬ জুলাই স্ত্রী-কন্যার সামনে গুলী করে হত্যা করা হয় মো. সেলিম উদ্দিনকে। ৭ অক্টোবর পাহাড়তলীতে ব্যবসায়ী আবদুল হাকিমকে মোটরসাইকেলযোগে এসে গুলী করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২৫ অক্টোবর গুলীতে প্রাণ হারান যুবদল কর্মী আলমগীর আলম। রাউজান থানা সূত্রে জানা গেছে, এসব হত্যার পেছনে রাজনৈতিক কোন্দল, বালু-মাটি ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে বিরোধ দায়ী। নিহতদের মধ্যে অন্তত ১৩ জন বিএনপি সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক হত্যার শিকার। এসব ঘটনায় অর্ধশতাধিক মামলা হলেও আসামী গ্রেফতারের হার খুবই কম।
রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, “হত্যাকাণ্ডগুলোর বেশিরভাগই পরিকল্পিত। আবার কিছু তাৎক্ষণিক ঘটনায় ঘটেছে পারিবারিক কারণে। হত্যার অভিযোগে অভিযুক্তদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।” রাঙ্গুনিয়ায় রক্তের দাগে রাঙ্গা রাজনীতি রাঙ্গুনিয়া উপজেলাতেও হত্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। গত ১৫ জানুয়ারি গৃহবধূ জরিনা বেগমকে তার স্বামী শাহ আলম পিটিয়ে হত্যা করেন। ২৫ মার্চ মীরেরখিল বাজারে ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম তালুকদারকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ১০ এপ্রিল লেমুছড়া এলাকায় পাহারা দিতে গিয়ে গুলিতে নিহত হন আওয়াইমং মারমা।
এছাড়া জুন মাসে শ্বশুর ওসমান গণিকে জামাতা হোসেন কুপিয়ে হত্যা করে, ২০ জুন লেবু বিক্রেতা শিবুই মারমাকে গুলী করে হত্যা করা হয়। জুলাইয়ে প্রবাস ফেরত মোহাম্মদ রাসেল, আগস্টে সন্ত্রাসী রুবেল এবং সেপ্টেম্বরে একাধিক নারী-পুরুষ খুন হন। পুলিশ জানায়, রাঙ্গুনিয়ার অনেক হত্যা এখনো রহস্যে ঘেরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। রাঙ্গুনিয়া মডেল থানার ওসি এটিএম শিফাতুল মাজদার বলেন, “প্রতিটি হত্যা মামলাই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। জড়িতদের শনাক্তে অভিযান চলছে।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিমশিম অবস্থা: চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, “রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ায় সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। পুলিশ সব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছে এবং জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। জনগণ যদি সহযোগিতা করে, অপরাধীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার মতে, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধ ও অর্থনৈতিক স্বার্থ মিশে গিয়ে চট্টগ্রামে হত্যাকাণ্ডের প্রবণতা বেড়েছে। ফলে গোটা জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।