খুলনায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলছে ইজিবাইক (অটো)। দিন দিন বেড়েই চলেছে ব্যাটারিচালিত এই যান। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সড়ক-মহাসড়ক। অনভিজ্ঞ চালকদের যত্রতত্র পার্কিংয়ে দুর্ভোগে পথচারীরা। ছুটছে অনুমোদনের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি ইজিবাইক। আমদানির পাশাপাশি অবৈধভাবে গড়ে উঠছে এই বাহনের কারখানা। ইজিবাইকের সংখ্যার পাশাপাশি বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদাও। প্রশাসনের চোখের সামনেই ইজিবাইক-অটোরিকশা চললেও কার্যকর পদক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

শিল্পনগরী খুলনার পাটকলগুলো বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা বেকার হয়ে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক-অটোরিকশা চালানোর পেশায় ঝুঁকছে। শহরে ব্যাটারিচালিত যানবাহন বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ এটি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে একদিকে তৈরি হচ্ছে অসহনীয় যানজট, অন্যদিকে বাড়ছে দুর্ঘটনা। ঝরছে অসংখ্য প্রাণ, পঙ্গুত্ববরণ করছেন অনেকেই।

জানা গেছে, গত বুধবার লবণচরা থানার দক্ষিণ মোহাম্মদ নগর স্লুইসগেট এলাকায় ইজিবাইকের ধাক্কায় মুনতাজিন (৫) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গত ২৫ আগস্ট সকালে ডুমুরিয়া উপজেলার খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের জিলেরডাঙ্গা এলাকায় ইজিবাইক ও পিকআপের সংঘর্ষের ঘটনায় চারজন নিহত হন। এতে মুহূর্তেই নিভে যায় চারটি পরিবারের আলোক প্রদীপ। এ সময় আহত হয় আরও চারজন। এর আগে গত ৯ জুন সকাল ৬টার দিকে খানজাহান আলী সেতুর (রূপসা সেতু) পশ্চিম প্রান্তে দারোগার লিজ নামক স্থানে ট্রাকের ধাক্কায় ইজিবাইকের চালকসহ দুইজন নিহত হন। চলতি বছরে ইজিবাইকের শুধু এই তিনটি ঘটনাই নয়, ঘটেছে আরও দুর্ঘটনা। হতাহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। গেল ৮ মাসে শুধু এই মহাসড়কে ১৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ইজিবাইক ছাড়াও অন্যান্য বাহনে দুর্ঘটনায় ঝরছে মানুষের প্রাণ।

খর্ণিয়া হাইওয়ে থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত গেল ৮ মাসে খুলনা-ডুমুরিয়া-পাইকগাছা-সাতক্ষীরা সড়কে ১৬টি দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত ও ১৭ জন আহত হন। শুধু এ সড়কটিই নয়, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিসংখ্যান মতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খুলনা জেলা ও মহানগরসহ বিভাগের ১০ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৬৮৯টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৬৩৩ জন। আহত হয়েছেন ৬৫১ জন। এরমধ্যে খুলনা জেলায় সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩৬টি। এতে নিহত হন ৪০ জন এবং আহত হন ২৯ জন।

ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, খুলনায় ৭২টি ইজিবাইকের চার্জিং পয়েন্ট রয়েছে। তাদের জন্য দৈনিক ৮৯১ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ বরাদ্দ থাকে। তবে স্থানীয় একাধিক সূত্র বলছে, খুলনায় কয়েকশ’ ইজিবাইকের চার্জিং পয়েন্ট রয়েছে। প্রতিটি চার্জিং পয়েন্টে ৫-২০টি ইজিবাইক চার্জ দেওয়া হয়। কোনো কোনো স্থানে এই সংখ্যা আরও বেশি। ফলে বিদ্যুৎ ঘাটতির অন্যতম কারণ হিসেবে দাঁড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ইজিবাইক চার্জিং পয়েন্টের মালিক জানান, একটি ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জে দৈনিক ১০-১২ ইউনিট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। প্রতি ইউনিটের জন্য ১৬ টাকা করে নেন তারা।

নগরীর সোনাডাঙ্গা থেকে গল্লামারী মোড় পর্যন্ত অসংখ্য ইজিবাইকের শো-রুম রয়েছে। চীন থেকে যন্ত্রপাতিসহ মালামাল আমাদানি করে তারা এখানেই ইজিবাইক ফিটিংস করে বিক্রি করেন। শুধু আমদানি করা ইজিবাইকই নয়, নগরীর শেখপাড়াসহ কয়েকটি স্থানে অবৈধভাবে তৈরি হচ্ছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) খুলনার সাধারণ সম্পাদক মো. মাহাবুবুর রহমান মুন্না বলেন, সিটি কর্পোরেশন ৭ থেকে ৮ হাজার লাইসেন্স দিয়েছে, কিন্ত ২৫-৩০ হাজার ইজিবাইক নগরীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে, যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। নগরীতে ইজিবাইক চলাচল নিয়ন্ত্রণে কেসিসি এবং কেএমপির ট্রাফিক বিভাগ সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বারবার বলা স্বত্বেও তারা কাজের কাজ করছে না। ইজিবাইক এখন নগরবাসীর কাছে বিষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে।

খুলনা সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্স অফিসার শেখ মো. দেলওয়ার হোসেন বলেন, সর্বশেষ ২০১৯ সালে নগরীতে ৭ হাজার ৮৯৮টি যাত্রীবাহী এবং ২০২১ সালে ২ হাজার ৯৬টি পণ্যবাহী ইজিবাইকের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এছাড়া ২০০৫-২০০৬ সালে ১৭ হাজার রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। তবে বর্তমানে রিকশার পরিমাণ কম রয়েছে। নগরীতে এখন ১৫ থেকে ২০ হাজার ইজিবাইক চলাচল করছে।