শহীদ আবু সাঈদের রংপুরে উন্নয়নে বৈষম্যের আর এক নির্মম চিত্র শিশু হাসপাতাল। নির্মাণ কাজ শেষে ভবন হস্তান্তরের সাড়ে ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও বহুল কাংখিত এবং র্দীঘ প্রত্যশিত ১০০ শয্যার বিশেষায়িত রংপুর শিশু হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গ শিশুস্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষায় এখনও অনিশ্চিত প্রহর গুনছে। হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবা থেকে র্দীঘদিন ধরে বঞ্চিত রয়েছে এই অঞ্চলের শিশুরা। সুর্দীঘ সময় ধরে অব্যবহৃত থাকায় এর বর্ণীল অবকাঠামো সমূহে ধুলায় ধুসর মলিন হয়ে এখন ভুতুরে বাড়ির পরিবেশ বিরাজ করছে। এর অন্যান্য সামগ্রীও ক্রমান্বয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় জনবল কাঠামো, অনুমোদন এবং অর্থ বরাদ্দের দীর্ঘসূত্রীতায় রংপুর অঞ্চলের শিশুরা এই কাঙ্খিত শিশুস্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত বলে জানা গেছে।

জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, রংপুর শিশু হাসপাতালের কাঙ্খিত শিশুস্বাস্থ্য সেবা আলোর মুখ দেখবে কবে? ইতোমধ্যে হাসপাতালটি নির্মাণের সাড়ে ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও এবং মুখ রক্ষার উদ্বোধনের আড়াই বছর অতিবাহিত হয়েছে। তবে রংপুর শিশু হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবা থেকে এই অঞ্চলের শিশুরা দীর্ঘদিন ধরে কাঙ্খিত সেবা বঞ্চিত হয়ে আজও এর আলোর মুখ দেখছে না।

সরেজমিন হাসপাতাল চত্বরে ঘুরে দেখা গেছে, বর্ণীল সাজে সজ্জিত রংপুর শিশু হাসপাতাল ভবনে যেন নির্জন এক ভূতুরে পরিবেশ বিরাজ করছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে এখানে সীমিত সেবায় বর্তমানে কেবল বহির্বিভাগ চালু রয়েছে। এজন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন আবাসিক চিকিৎসক, ৪ জন নার্স এবং নিরাপত্তা প্রহরীরা কর্মহীন অলস সময় কাটাচ্ছেন। এর চত্বরে শিশুদের জন্য নির্মিতি বিভিন্ন খেলার জমকালো রাইডগুলো দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত থাকায় এর অবকাঠামোসহ অন্যান্য সামগ্রী ধুলায় মলিন অবস্থায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

প্রকাশ, প্রায় ২ কোটির অধিক জন অধ্যুষিত রংপুর বিভাগের ৮ জেলার শিশুদের বিশেষায়িত স্বাস্থ্য সেবার লক্ষ্যে মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রে পুরাতন সদর হাসপাতাল চত্বরে সাড়ে ৬ বছর আগে প্রায় ১ দশমিক ৭৮ একর জমির উপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এবং স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে শিশু হাসপাতালটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়।

সে সময় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট এটির সকল ভবন হস্তান্তর করেন। এরপর করোনার ডামাডোলে এখানে শিশুদের চিকিৎসা সেবার কার্যক্রমের উদ্যোগ বন্ধ রেখে এটিকে করোনার বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে করোনার প্রাদুর্ভাব অনেক আগেই মুছে গেলেও অজ্ঞাত কারণে শিশু হাসপাতালের কার্যক্রম আজও পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা হয়নি। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ২০২৩ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারী রংপুর ১০০ শয্যার শিশু হাসতালটির ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন করা হয়।

এই অঞ্চলের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল যে এবারে শিশু হাসপাতালটির স্বাস্থ্যসেবার কার্যক্রম আলোর মুখ দেখবে। তবে সে আশা এখন অফুরন্ত অনিশ্চয়তার প্রহর গুনছে। উদ্বোধনের আড়াই বছর অতিবাহিত হলেও এর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংযোগ, জনবল নিয়োগ এবং অর্থ বরাদ্দ করে শিশুদের স্বাস্থ্য সেবার পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম এখন পর্যন্ত শুরু করা হয়নি।

স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রংপুর পুরাতন সদর হাসপাতাল চত্বরের প্রায় ১ দশমিক ৭৮ একর জমির উপর প্রায় সাড়ে ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালের ২১ শে নভেম্বর এই শিশু হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এর নির্মাণকাজ ২ বছর সময় বেঁধে দেয়া হলেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের আগেই এর কাজ সম্পন্ন করেন। ২০২০ সালের ৮ই মার্চ হাসপাতাল ভবনটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করার জন্য জেলা সিভিল সার্জনের নিকট হস্তান্তর করা হয়।

নবনির্মিত এই শিশু হাসপাতাল ক্যাম্পাসে তিনতলা বিশিষ্ট মূল হাসপাতাল ভবনের প্রতি তলায় ২০ হাজার ৮৮২ বর্গফুট আয়তন সহ মোট ৬২ হাজার ৮৪৬ বর্গফুট আয়তনের হাসপাতালের প্রথম তলায় জরুরী বিভাগ, বহির্বিভাগ, চিকিৎসকদের চেম্বার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরীর ব্যবস্থা রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় অপারেশন থিয়েটার ও ব্রোন ইউনিট এবং তৃতীয় তলায় শিশু ওর্য়াড এবং কেবিনের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া এখানে ৬ তলা বিশিষ্ট ডাক্তারদের আবাসিক ভবন এবং স্টাফ ও নার্সদের আবাসিক ভবন, তিন তলা বিশিষ্ট সুপারিনটেনডেন্ট কোয়াটার, দুইতলা বিশিষ্ট গ্যারেজ কাম ড্রাইভার কোয়াটার, কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সাপ্লাই সিষ্টেম, বিদ্যুৎ সাবস্টেশন, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, অভ্যন্তরীন সড়ক তৈরি করা সহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। শিশু হাসতালটি চালু হলে এখানে এই অঞ্চলের শিশুদের বিনামূল্যে জটিল অপারেশনসহ বিশেষায়িত উন্নত চিকিৎসা সেবার পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত অবকাঠামো সমূহ নির্মাণের পর করোনার প্রার্দুভাবের কারণে সে সময় এই হাসপাতালটিকে করোনা ডিটেকটিভ হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং শূণ্যের কোঠায় নেমে এলেও রহস্যজনক ভাবে দীর্ঘদিনেও শিশু হাসপাতালটি চালু করা হয়নি। এর ফলে রংপুর অঞ্চলের শিশুদের জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য ঢাকাসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছুটতে হচ্ছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সীমিত পরিসরে বর্তমানে এই অঞ্চলের শিশুদের চিকিৎসা সেবায় প্রয়োজনীয় জনবল সহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকটে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। এ কারণে এখানে শিশুদের মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া যাচ্ছেনা।

এ ব্যাপারে রংপুরের সিভিল সার্জন ডাক্তার শাহীন সুলতানা এই প্রতিবেদককে জানান, রংপুরে ১০০ শয্যার শিশু হাসপাতাল চালুসহ স্বাস্থ্যখাতের বিভন্ন বিষয়ের সমস্যার ব্যাপারে বিগত ১৭-১০-২৪ তারিখে সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রশাসনিক অনুমোদন, জনপ্রশাসন কর্তৃক পদ সৃজন এবং অর্থ বরাদ্দের অনুমোদন চেয়ে মন্ত্রণালয়ে লিখিত ভাবে অভিহিত করা হয়। এর প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী এসবের বাস্তব চালচিত্র সম্বলিত একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করে গত ৫ ই নভেম্বর অধিদফতরে প্রেরণ করা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয় যে দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত থাকায় এর অবকাঠাসো সহ অন্যান্য সামগ্রী ক্রমান্বয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় চাহিদাপত্র স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং জনবল পাওয়া গেলেই এটি চালু করা হবে। তবে এ ব্যাপারে এখনও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে রংপুর বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য পরিচালক ডাক্তার ওয়াজেদ আলী এই প্রতিবেদককে জানান, রংপুর শিশু হাসপাতালের পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল, বরাদ্দ এবং অনুমোদনের জন্য চাহিদা নির্ধারণ করে কয়েক মাস পূর্বে মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। এখনও কোন আদেশ পাওয়া যায়নি। তিনি স্বীকার করেন অব্যবহৃত থাকায় অবকাঠামো সহ অন্যান্য সামগ্রী ধুলাবালিতে মলিন হচ্ছে।

রংপুর শিশু হাসপাতাল চালুর বিষয়ে জেলার ডেপুটি কমিশনার মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল এ প্রতিবেদককে বলেন, গত ফেব্রুয়ারী মাসে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একটি তাগাদাপত্র দেয়া হয়েছে। তবে এটি চালু করার ব্যাপারে কার্যকর কোন আদেশ এখনও পাওয়া যায়নি।