ইকবাল হোসেন (শ্রীপুর) সংবাদদাতা : গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা বাজারে বিগত ৩৫ বছর ধরে গড়ে উঠেছে এক ব্যতিক্রমী হাট-যেখানে পশু, নিত্যপণ্য বা কৃষিপণ্য নয়; কেনাবেচা হয় পুরোনো সাইকেল, ভ্যানগাড়ি, অটোরিকশা ও প্যান্ডেল রিকশা। সপ্তাহে দুই দিন বসা এই হাট এখন নি¤œ আয়ের মানুষের জীবিকা টিকিয়ে রাখার এক নির্ভরযোগ্য ভরসায় পরিণত হয়েছে।
প্রতি বৃহস্পতিবার ও রবিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাওনা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এই হাট। ২০ নভেম্বর দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়-মাঠজুড়ে সারি সারি সাজানো পুরোনো অটোরিকশা, ভ্যানগাড়ি ও বাইসাইকেল। শ্রীপুর ছাড়াও কালিয়াকৈর, কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া ও আশপাশের উপজেলা থেকে আসা ক্রেতা-বিক্রেতায় পুরো মাঠ মুখর। পছন্দের যানটি পেয়ে কেউ ফিরছেন তৃপ্ত মনে, কেউ আবার খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন।
বিকেলের রোদটা একটু নরম হতেই হাট প্রাণ ফিরে পায়। পুরোনো ভ্যানগাড়ির চাকার শব্দ, দরদামের উত্তাপ আর অটোরিকশার হর্ন-সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক প্রাণবন্ত পরিবেশ। এখানে প্রতিটি যানবাহনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একটি পরিবারের গল্প, কেউ নতুন করে পথচলার স্বপ্নে আসে, কেউ জীবিকার চাকা ঘুরিয়ে দেওয়ার তাগিদে।
হাটের মাঝামাঝি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো পুরোনো অটোরিকশার পাশে ব্যবসায়ীরা ব্যাটারি, ব্রেক, সিট-সব কিছুই বারবার পরীক্ষা দেখছেন। যেন প্রতিটি যানের ভিতরেই তারা নিজের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা খুঁজছেন।
এক কোণে দেখা গেল বয়স্ক আব্দুল রহিম মিয়াকে। তিনি তাঁর পুরোনো ভ্যানটি আদর করে হাত বুলিয়ে দেখছিলেন। গলা আটকে আসছিল। “এই ভ্যান চালাইয়া তিন ছেলের পড়াশোনা করাইছি। আজ বিক্রি করে দিতেছি-ওদের ভালো ভবিষ্যতের জন্যই।” কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ ভিজে ওঠে। ভ্যানটি যেন তাঁর কাছে পরিবারের ইতিহাস। আজ তা যাবে অন্যের হাতে, কিন্তু তাঁর হৃদয়ে রয়ে যাবে জীবনের স্মৃতি হয়ে।
মানুষের হাসি-কান্নার মেলবন্ধন এই হাট এ হাটে কেউ প্রথম সাইকেল কিনে নিজের পথচলার সাহস খুঁজে পান, কেউ পুরোনো অটোরিকশা কিনে নিজের জীবিকার নতুন অধ্যায় শুরু করেন। আবার কেউ নিজের পুরোনো যান বিক্রি করে বড় স্বপ্নের দিকে হাঁটতে শুরু করেন।
শ্রীপুরের এই হাট তাই শুধুই বাজার নয়-এটি মানুষের সংগ্রাম, আশা, স্বপ্ন আর আবেগের এক অসাধারণ মিলনমেলা।
হাট কর্তৃপক্ষ জানায়, এখানে যানবাহন তোলার জন্য কোনো খাজনা দিতে হয় না। তবে বিক্রি সম্পন্ন হলে ক্রেতাকে গুনতে হয় ৪২০ টাকা এবং বিক্রেতাকে দিতে হয় ৩২০ টাকা। নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতেই এ নিয়ম মেনে চলা হয়। ক্রেতা-বিক্রেতাদের মতে, কম টাকায় ভালো যান পাওয়ার সম্ভাবনাই এই হাটে মানুষের ঢল নামার প্রধান কারণ।
হাট পরিচালক সাখাওত হোসেন শওকত বলেন, “শ্রীপুর এলাকায় অনেক শ্রমজীবী মানুষ আছেন, যাদের নতুন যান কেনার সামর্থ্য নেই। তারা এখানে এসে স্বল্প টাকায় ভালো মানের পুরোনো সাইকেল বা অটোরিকশা কিনে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন। এই হাট তাদের পরিবারের ভরসা।”
৩৫ বছরের ঐতিহ্য-মানুষের জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ মাওনা বাজারের এই পুরোনো যানবাহনের হাট শুধু বেচাকেনার নয়; এটি বহু মানুষের স্বপ্ন পূরণের পথ। কম দামে চলার উপায় খুঁজে পাওয়া সাধারণ মানুষের কাছে তাই এই হাট আশার আলো হয়ে আছে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে।