কুষ্টিয়ার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শিশু পার্ক শুধুমাত্র ‘জিয়া’ নাম থাকার কারণে দুই দশক পরিত্যক্ত রয়েছে। পার্কে শিশুদের পদচারণা বা কোলাহল নেই। যদিও একসময় মানুষের ভিড় লেগে থাকা এপার্কে সারাএখন দিনেও মেলে না ৫০ জন দর্শনার্থী। একটু বিনোদনের আশায় শিশু-সন্তানদের নিয়ে শহরের বাসিন্দারা দূর গ্রামে ছুটলেও ঘরের কোণে থাকা পার্কটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বর্তমানে পার্কটি মাদকসেবী, প্রেমিক যুগল আর বখাটেদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে।
জানা যায়, ৮০-৯০ এর দশকে প্রতিষ্ঠিত পার্কটিতে রয়েছে পুকুর, সুইমিং পুল, হাঁটার রাস্তা ও শিশুদের বিনোদনের জন্য হরিণসহ কয়েক প্রজাতির পশুপাখি। তবে সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় পার্কটি দিন দিন তার জৌলুস হারিয়েছে। বিশাল আয়তনের পুকুরটিতে একসময় মাছ চাষ হলেও বর্তমানে তা বন্ধ রয়েছে।
সরেজমিনে পার্কে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে একটি সুইমিং পুল। সেখানে শিশু-কিশোরদের সাঁতার শেখানোর উদ্যোগে সাড়া মিললেও পর্যাপ্ত ট্রেনার ও সুযোগ-সুবিধা না থাকায় আগ্রহ হারাচ্ছেন অভিভাবকরা। প্রধান গেটে মোজাইকের ওপর ছবিসহ কালো কালি দিয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কথাটি বড় অক্ষরে আর লাল কালি দিয়ে ছোট অক্ষরে শিশু পার্ক লেখা। জায়গায় জায়গায় মোজাইক উঠে গিয়ে ইট দেখা যাচ্ছে। এক নজর তাকালেই বোঝা যাবে দীর্ঘদিন এখানে সংস্কার বা যত্নের কোন ছোয়া লাগেনি। শুধুমাত্র নামের কারণে দুই দশক ধরে ‘পরিত্যক্ত’ আছে জিয়াউর রহমান শিশু পার্ক।
ভেতরে ঢুকতেই কাউন্টাওে বসা ইনচার্জ তরিকুল ইসলাম বলেন, সারাদিনে ২০-৩০ জন দর্শনার্থী আসে। অথচ একটা সময় অনেক মানুষ আসতো। এখন আর তেমন আগ্রহ নেই মানুষের।
পার্কের মাঝামাঝি খাঁচায় কবুতর ও শেষ প্রান্তে একটি বড় খাঁচায় ১৫টি হরিণ রয়েছে। হরিণগুলোর জন্য খাঁচার ভেতর কোনো খাবার দেখা না গেলেও দায়িত্বশীলরা জানান, প্রতিদিনই ঘাস ও অন্যান্য খাবার দেওয়া হয়। পার্কের ডানপাশে পুকুরের চারদিকে বন-জঙ্গল। সাপ-পোকার ভয়ে পুকুরপাড়ে হাঁটা দায়।
শহরের সচেতন নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নোংরা রাজনীতির বলি হয়ে রয়েছে এক সময়ের কোলাহল পূর্ণ এই শিশু পার্কটি। শুধু শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম থাকায় পার্কটি গত প্রায় দুই দশক ধরে অযত্ন-অবহেলায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
জানা গেছে, বিএনপির শেষ সময় এবং আওয়ামীলীগের টানা তিন মেয়াদে গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা চার মেয়াদে প্রথম শ্রেণির কুষ্টিয়া পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার আলী। তিনি এক মেয়াদ বাদ দিয়ে কুষ্টিয়া পৌরসভার পাঁচবারের নির্বাচিত মেয়র।
সচেতন নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের দাবি, নোংরা রাজনীতির অংশ হিসেবে শুধু শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামে হওয়ার কারণে পাঁচ মেয়াদে দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর কুষ্টিয়া পৌরসভার চেয়ারম্যান ও মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালে আওয়ামীলীগ নেতা আনোয়ার আলী পার্কটির উন্নয়নতো দূরের কথা, দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার না করে পার্কটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে দিয়েছেন। ২০০০ সালে আনোয়ার আলীকে ভোটে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রয়াত খন্দকার ইসরাইল হোসেন আফু। তিনিও পার্কটি সংস্কার করার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী কুষ্টিয়ার সন্তান কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর সহায়তায় শহরের ঈদগাহ পাড়া এলাকায় কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর নামে নতুন একটি শিশু পার্ক নির্মাণ করেন।
এ বিষয়ে পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, সম্প্রতি গুলশানের একটি পার্ক আমরা পরিদর্শন করে দেখেছি। সেটা সবসময় জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকে। সেখানে শহরের বাসিন্দারা বিশ্রাম নিতে পারেন। আমরা সেই আদলেই জিয়াউর রহমান শিশু পার্কটি সাজানোর পরিকল্পনা করছি। খুব শিগগির এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
পার্কটি শুধুমাত্র নামের কারণে প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে অবহেলিত বলে দাবি করেন কুষ্টিয়া জেলা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির সিনিয়র নেতারা। তারা বলেন, এ কথা সত্য শুধু নামের কারণেই পার্কটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে ছিল। ৫আগস্টের পর দলীয়ভাবে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য পার্কে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম সামান্য হলেও হয়েছে। সেখানে মানুষ হাঁটার পরিবেশ ও শিশুদের বিনোদনের সুব্যবস্থা করা জরুরি। জেলা বিএনপির সদস্য সচিব জাকির হোসেন সরকার, জেলা জামায়াতের আমীর অধ্যাপক আবুল হাশেম, এনসিপির অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন, গনঅধিকার পরিষদের শাকিল আহমেদ তিয়াস বিষয়টি দুঃখজনক বলে উল্লেখ করে দ্রুত সংস্কার করার দাবী করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান লাকী এব্যাপারে জানান, পার্কটি চরম বেহাল অবস্থায় আছে। পশুপাখীগুলো ঠিক মত খাবার পায় না, পুকুরের চারধারে জঙ্গলে ছেয়ে গেছে, অবৈধ ভাবে প্রেমিকযুগল পার্কে ঢুকে অশ্লীলতা করছে। তিনি সুস্থ্য পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জোর দাবী করেন।