প্রায় তিন যুগ ধরে খুলনাঞ্চলের উপকূলে পানি সংকট নিরসনে বিভিন্ন কাজ হলেও সুপেয় পানির সংকট বেড়ইে চলেছে। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরার অন্তত ৯ উপজেলার ৫০টিরও বেশি ইউনিয়নের ২৫-৩০ লাখেরও বেশি পরিবার সুপেয় পানির সংকটে। এসব এলাকার মানুষকে সুপেয় পানির জন্য রীতিমত সংগ্রাম করতে হয়। একটু বিশুদ্ধ পানি মহামূল্যবান তাদের কাছে।

আঞ্চলিক ভাষায় পানির কষ্টের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার পশ্চিম বাজুয়ার ছিটেবুনিয়া গ্রামের তরমুজ চাষি গৌতম বলেন, ‘পানির কতা নোতুন করে কি কবো? খ্যাতে কাজ কত্তিচি সেই কহনেত্তে, কারও বাড়ি যায়ে পানি চালি তাজ্ঞে মুখ ভার হুতেচ। ফাঁকায় এক বাড়ি কুরেচ (করেছে) কারা, তাজ্ঞেনে বিষ্টির পানি ভরে থুয়েচ, গেলি খাতদে, তা পেত্তো গেলি কি ভালো মুহি দে? দক্কিন পাড়ায় এট্টা কল আচ তা স্যানে রাজ্জির মানসির ভিড়। তরমুজির বিলি পানি দেবে কন্তে? খাল শুয়োয়ে গেচ সেই পোত্তোমেত্তে! এহন দুরিত্তি জল বয়ে বয়ে আনতি বিটিগে জান শেষ। মানসি পাতেছ না তায় তরমুজ। খাল পুরে গে, না কাটলি মানুষ বাঁচপেন বোলে মোনে অয় না। ’

একই উপজেলার ওড়াবুনিয়া সাহেবের আবাদ গ্রামের সাথী বৈদ্য বলেন, দীর্ঘ খরা আর প্রচন্ড তাপদাহে মানুষ এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। খাল-বিল-পুকুরের পানি শুকিয়ে মাটি ফেটে গেছে। খাবার পানির তো কোন খোঁজই নেই। আশপাশে দূরের কোথাও থেকে গভীর নলকূপের পানি সংগ্রহ করলেও রান্না, গোসল কিংবা ব্যবহারের পানির জন্য চলছে হাহাকার।

কয়রায় সুপেয় পানির ভয়াবহ সংকটের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে এম এম সাইফুল ইসলাম বলেন, সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে খুলনা জেলার কয়রা উপজেলা। সুন্দরবন বেষ্টিত উপকূলীয় এ উপজেলায় সুপেয় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। তিনটি ইউনিয়নের সম্পূর্ণ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারযোগ্য নয়। অপর চারটি ইউনিয়নের কিছু এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি পানযোগ্য হলেও পানির স্তর নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপে ঠিকমতো পানি উঠছে না। বিশেষ করে সর্বদক্ষিণের দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের নলকূপগুলো দিয়ে কোন পানি উঠছে না।

এদিকে, অধিকাংশ এলাকায় নোনাপানির মাছ চাষ হওয়ায় মিঠা পানির পুকুরগুলোও লবণাক্ততায় ভরে উঠেছে। কিছু এলাকায় মিঠা পানি থাকলেও পুকুরগুলো ভরাট হয়ে দূষণে ভরে গেছে। অনেক পুকুরে শুষ্ক মওসুমে পানি থাকে না। তদারকির অভাবে পুকুরে স্থাপিত দুই শতাধিক ফিল্টারের প্রায় সবগুলো নষ্ট অবস্থায় রয়েছে। শুষ্ক মওসুমে এ উপজেলার প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষের পানির জন্য কষ্টে দিনতিপাত করতে হচ্ছে।

বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার বুড়বুড়িয়া গ্রামের মরিয়ম খাতুন বলেন, আমাদের গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এ গ্রামের মানুষের লবণাক্ত পানিতে জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গ্রাম থেকে প্রায় সাত আট কিলোমিটার দূর থেকে পানি কিনে আনতে হয় পুকুরের পানি। প্রতি ড্রাম পানির দাম ৪০ টাকা। এখানকার মানুষের একমাত্র পানির উৎস হলো বৃষ্টির পানি আর ফুলপুকুরের পানি। রামপাল উপজেলায় ফুলপুকুর অবস্থিত। এক উপজেলা থেকে আরেক উপজেলায় পানি আনতে হয়। খাবার পানি ছাড়া মানুষের দৈনন্দিন কাজ লবণাক্ত পানি দিয়েই করতে হয়।

সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার বাসিন্দা রিয়াদ হোসেন জানান, উপজেলার অধিকাংশ পুকুর এবং খাল-বিলগুলো শুকিয়ে গেছে। টিউবওয়েল থেকেও ঠিকমতো পানি উঠছে না। ফলে খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতিবছরই এ উপজেলায় পানি সংকটের সম্মুখীন হয় কয়েক লক্ষ মানুষ। সরকারি-বেসরকারিভাবে কিছু সংগঠন পানি সংকট নিরসনে এগিয়ে আসলেও এখনো পর্যন্ত স্থায়ী কোনো সমাধান হয়নি। এ জন্য নিরাপদ খাওয়ার পানির সংকট কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।

খুলনা জলবায়ু অধিপরামর্শ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, অবস্থানগত ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে সুপেয় পানির সংকট দিনে দিনে বেড়েই চলছে। এই সংকট দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় সবচেয়ে বেশি। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ সুপেয় পানির জন্য বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টি কম হলে পুকুরের পানিও কমে আসে, পানির গুণগতমান নষ্ট হয়। ফলে সুপেয় পানি পাওয়া প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বর্তমানে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় এলাকার প্রায় ২৫-৩০ লাখ মানুষ সুপেয় পানির অভাবে রয়েছে। বাংলাদেশ পানি আইনের ধারা-১৭ অনুযায়ী উপকূলীয় অঞ্চলকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানান তিনি।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জামানুর রহমান বলেন, এ অঞ্চলের মানুষের সুপেয় পানি সংকটের বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা দশ ধরনের টেকনোলজি ব্যবহার করে উপকূলীয় অঞ্চলসহ খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলার গ্রামাঞ্চলে পানি সরবরাহ করছি। শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই জলবায়ুুর পরিবর্তন এবং ফারাক্কা বাধেঁর কারণে পানির স্তর নিম্নমুখী। সে কারণে আমাদের যে পানির উৎস গুলো আছে সেগুলো সচল করার চেষ্টা করছি। যাতে করে মানুষের পানির কষ্ট লাঘব হয়।