খালিদ হাসান সিপাই, কুষ্টিয়া : আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের পরও কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না মাদকের বিস্তার। কুষ্টিয়ার বিভিন্ন জায়গায় মিলছে মাদক। প্রকাশ্যে বিক্রির কারণে দিন দিন মাদকসেবী বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। এদিকে পুলিশ বলছে, সব ধরনের মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের বিরুদ্ধে চলছে অভিযান ও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা।
মাদকদ্রব্য এখন সর্বত্র কুষ্টিয়া শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলে। এমন কোন পাড়া-মহল্লা ও গ্রাম নেই যেখানে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ নেশার উপকরণ পাওয়া যাবে না। পুরো জেলা যেন এখন মাদকের উপর ভাসছে। এই সর্বনাশা মাদকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র-ছাত্রীরা আসক্ত হচ্ছে ব্যাপকহারে।
বর্তমানে মাদকাসক্তদের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় জাতি মেধাশূন্য হওয়ার চরম হুমকি দেখা দিয়েছে। বেকারসহ অন্য পেশার চেয়ে মাদকাসক্তদের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা ব্যাপক। অভিভাবকগণ উৎকণ্ঠিত। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো স্কুলগামী শিশুরা এই সর্বনাশা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। তাদের সংখ্যাও বাড়ছে। তবে শিশুদের আসক্ত হওয়ার হার গ্রামাঞ্চলেই বেশি।
জানা গেছে, মাদক ব্যবসায়ী কিংবা বিক্রেতারা ভেজাল ও বিষাক্ত মাদকদ্রব্য স্বল্পমূল্যে বিক্রি করছে। ফেনসিডিলে মেথিলেটেড স্পিরিট, হেরোইনের পরিবর্তে ব্রাউন সুগার ও কুকুর মারার বিষ। ভেজাল ও বিষাক্ত মাদক আসছে সীমান্ত পথে। এই সব বিষাক্ত ও ভেজাল মাদকদ্রব্য সেবনে আসক্তদের মধ্যে মৃত্যু বেড়েছে আশংকাজনক হারে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মাদকদ্রব্য এদেশে উৎপাদন হয় না; বাইরে থেকে আসে। মাদকদ্রব্য আসার পথ বন্ধ করা গেলে দেশের অভ্যন্তরে মাদকদ্রব্য পাওয়া যাবে না। এই পথে সঠিক ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে কেবল দেশে মাদক আসা বন্ধ করা সম্ভব। যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য দেশে আসছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ ও র্যাব মিলে জিরোভাগও উদ্ধার করতে পারছে না। সর্বনাশা মাদক প্রতিরোধে সীমিত জনবল দিয়ে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
জানা গেছে, মোবাইল কোর্ট চালু করে মাদকের স্পট ধ্বংস করা হচ্ছে। শহর, উপজেলা ও ইউনিয়নে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন ও গাঁজার বেচা-কেনা এবং সেবন চলছে প্রকাশ্যে।
গ্রামাঞ্চলে হাট-বাজারে ও বাড়ি বাড়িতে মাদক সেবন এবং বেচা-কেনা চলছে।
বাংলাদেশের অন্যতম সীমান্তবর্তী উপজেলা কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা। ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত দৌলতপুর উপজেলার ৮টি ইউনিয়নই সীমান্তবর্তী এলাকাজুড়ে অবস্থিত। এই সীমান্তবর্তী এলাকায় দেদারছে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শীর্ষ মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের একাংশ।
অনুসন্ধানে তথ্য পাওয়া যায়, সন্ধ্যা হতে রাত পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী সীমান্ত ভারতের তারকাটা হতে অবৈধভাবে অস্ত্র, মাদক গাঁজা, ফেনসিডিল, টাপেন্টাডল ট্যাবলেট আমদানি সিন্ডিকেটের একাংশ দাপাদাপি করে নিষিদ্ধ মাদক আমদানির জন্য।
আর আমদানিকারকদেরই একাংশ সিন্ডিকেট জমজমাট করে ওপেন সিক্রেট ভাবে প্রস্তুত থাকে খুচরা বিক্রির জন্য। দুপুর ৩টা হতে মাঝরাত পর্যন্ত চলে অবৈধভাবে অস্ত্র, মাদক ফেনসিডিল, গাঁজা বিক্রির রমরমা ওপেন সিক্রেট বাজার আর মাঝ রাত হতে ভোর পর্যন্ত চলে মাদক আমাদানি করে সংরক্ষণ। আদাবাড়ীয়া ইউনিয়নের ধর্মদহ পশ্চিমপাড়া নামক গ্রামে রয়েছে মাদক আমদানিকারকদের বেশ গ্রুপ ভিত্তিক বড় সিন্ডিকেট। তবে বর্ডার হতে অবৈধভাবে আমদানি করা অস্ত্র, মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটে রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা শাখার তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের নাম। দৌলতপুর থানা হতে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দুরুত্ব হওয়ার কারণে আদাবাড়ীয়া ইউনিয়নের ধর্মদহ গ্রামের পাশেই রয়েছে তেকালা পুলিশ ফাঁড়ী, তবে নেই কোনো পূর্বের মতো মাদক উদ্ধার, নেই কোনো মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান, নেই কোনো মাদক মামলা। ৫ আগষ্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রশাসনের কিছুটা নিস্ক্রিয় ভূমিকার কারণে এই পৃষ্ঠপোষকতাকারী প্রভাবশালী সিন্ডিকেট বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
তবে বর্তমানের চিত্রটা একেবারেই আলাদা, অস্ত্র,মাদকের স্বর্গরাজ্য ও ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের রাজ্য হিসেবে পরিণত হয়েছে কুষ্টিয়ার সীমান্তবর্তী উপজেলা দৌলতপুর।
অর্ধশতাধিক গ্রামে খোঁজ-খবর নিয়ে এই সর্বনাশা তথ্য পাওয়া যায়। উপজেলায় তরুণ মাদকাসক্তির সংখ্যা বেশি। প্রতি ঘরে ঘরে মাদকাসক্ত রয়েছে। অন্যান্য উপজেলায়ও মাদক সেবন পরিস্থিতি কম নয়। প্রতিটি উপজেলার প্রতিটি গ্রামে ফেনসিডিল ও গাঁজার বেচাকেনা এবং সেবন চলছে ব্যাপকহারে। তবে হেরোইন ও ইয়াবা ট্যাবলেটের ব্যবহার কম নয় শহর ও গ্রামাঞ্চলে ফেনসিডিল ও গাঁজা সেবন চলছে আশংকাজনক হারে।
এর পাশাপাশি চলছে অনলাইন জুয়া। শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলে মোবাইলে টাকার বিনিময়ে লুডু খেলার জুয়া। সর্বশান্ত হচ্ছে গ্রামের সাধারণ মানুষ।
কুষ্টিয়া মাদক নিরাময় চিকিৎসকদের অভিমত, অধিকাংশ মাদকাসক্তের মৃত্যুর মূল কারণ মাদক দ্রব্যের বিষক্রিয়া। এছাড়া ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ জাতীয় নেশার ট্যাবলেট, ইনজেকশন গ্রহণে হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বন্ধ হয়েও অনেক মাদকাসক্ত মারা যাচ্ছে। মান-সম্মানের হানি হওয়ার আশংকায় অনেক মাদকাসক্তের মৃত্যুর কথা চেপে যাওয়া হয়। আত্মীয়-স্বজন মিলে লাশ দাফন সম্পন্ন করে আসছে। হাসপাতালের চিকিৎসক জানিয়েছেন, পেটের ব্যথা, হার্টের ব্যথা নিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে অধিকাংশ মাদকাসক্ত।
মাদক বিরোধী কাজ করছে এমন কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা মতে মাদকাসক্ত ৭০ ভাগই তরুণ ও স্কুল-কলেজের ছাত্র। সন্ম্রান্ত, শিক্ষিত ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, রাজনৈতিক দলের সন্তান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য মাদকাসক্ত। ১০ ভাগ শ্রমিক শ্রেণীর। ১০ ভাগ নারী মাদকাসক্ত। শিশুরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত নারী, পুরুষ ও শিশু।
সুশীল সমাজের মতে, এই পরিস্থিতিতে সরকার, আদালত ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। জামিন প্রক্রিয়ায় আরও কড়াকড়ি আরোপ করা জরুরী, বিশেষ করে ছিনতাই ও মাদক মামলার মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। নিয়মিত মনিটরিং, জামিনপ্রাপ্ত আসামিদের কার্যকলাপের ওপর নজরদারি এবং প্রয়োজনে জামিন বাতিলের প্রক্রিয়া দ্রুত কার্যকর করতে হবে। এছাড়া বিচারপ্রক্রিয়ার গতি বাড়াতে হবে, যাতে মামলার দীর্ঘসূত্রতা অপরাধীদের কোনো রকম সুবিধা না দেয়। মামলার তদন্ত দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করা হলে বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বাড়বে এবং আদালতের সিদ্ধান্তে আস্থা তৈরি হবে।
কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ সূত্র জানায়,মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে অস্ত্র এবং যে কোন অপরাধের বিষয়ে যেখানেই তথ্য পায় সেখানে আমাদের অভিযান চালানো হয়। আমাদের অভিযান চলমান আছে। অপরাধী যেই হোক কোনো ছাড় দেওয়া হবেনা।
কুষ্টিয়ার সীমান্তবর্তী দিয়ে প্রতিদিন আসছে মাদক। বিভিন্ন আইটেমের এ মাদক ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলে। জেলার বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়িয়ে পড়েছে নেশায়।
এ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও মাদকসেবীদের রোধে প্রশাসনকে আরোও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি মাদকের বিস্তার রোধে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে তাগিদ দিচ্ছে পুলিশ।