সিসিটিভির ফুটেজে খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর থানা যুবদলের বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি মাহবুবুর রহমান মোল্লা হত্যাকাণ্ডের ঘাতকদের চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সেই ছবি দেখে স্থানীয়রাও বলছেন, চরমপন্থি নেতা হুমার সহযোগীরা এ হত্যাকান্ডে অংশ নেয়। সড়কের দুই পাশের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। স্থানীয়দের মাধ্যমে ফুটেজের কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়ে। এতে মোটরসাইকেলে থাকা তিন যুবককে চিহ্নিত করেন এলাকাবাসী।
এদিকে রোববার রাত সাড়ে ১২ টার দিকে পশ্চিম মহেশ্বরপাশা এলাকা থেকে মাহবুব হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আলাউদ্দিন (২২) নামের আরও এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেই ওই এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলামের ছেলে। এর আগে শনিবার রাতে এ হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সজল নামের এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বর্তমানে ওই যুবক দৌলতপুর থানায় দু’দিনের রিমান্ডে রয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মাহবুব হত্যা মামলায় এ নিয়ে দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ফুটেজে দেখা গেছে, মাহবুবকে হত্যার সময় একটি মোটরসাইকেলে চালক হেলমেটপরা রায়হান, মাঝে বসা আসিফ এবং পেছনে বসা ইমন নামের এক যুবক। এরাসহ কয়েকজন অস্ত্র মামলায় আট মাস কারাগারে ছিল। গত জুনের শেষ দিকে তারা জামিনে ছাড়া পায়। পুলিশ জানায়, কারাগার থেকে বের হয়ে এসে একটি ভবন দখলের ঘটনা নিয়ে মাহাবুব ও তাঁর বন্ধু জাকিরের বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেয়। এছাড়া আরেক চরমপন্থি আরমানের সঙ্গে সখ্য, আধিপত্য বিস্তার, মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ এবং গত অক্টোবরে তাদের পুলিশে ধরিয়ে দেয়া নিয়ে হুমা অনুসারীদের সঙ্গে মাহাবুবের দ্বন্দ্ব ছিল।
এদিকে হত্যায় জড়িত সন্দেহে শনিবার গভীর রাতে সজল নামে এক যুবককে মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়া এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। রোববার আদালতের মাধ্যমে তাঁকে দু’দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) তাজুল ইসলাম বলেন, হত্যার সময় সজল কাছাকাছি থেকে দুর্বৃত্তদের তথ্য দিয়েছেন। তাঁর তথ্যের ভিত্তিতেই দুপুরে ফাঁকা রাস্তায় দুর্বৃত্তরা হত্যা করে পালিয়ে যায়। ১১ জুলাই দুপুরে দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ার নিজ বাড়ির সামনে মাহাবুবকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাঁর পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। হত্যার আগে মাহাবুব ও স্থানীয় এক যুবক প্রাইভেটকার পরিষ্কার করছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী যুবক জানান, মোটরসাইকেলে আসা তিন যুবক প্রাইভেটকারের সামনে দাঁড়ায়। শুধু একজনের মাথায় হেলমেট ছিল। সন্ত্রাসীরা মাহাবুবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে তিনি পালিয়ে যান। হত্যা শেষে ওই মোটরসাইকেলে করেই তারা চলে যায়। ওই সড়কের দু’পাশের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। স্থানীয়দের মাধ্যমে ফুটেজের কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়ে। এতে মোটরসাইকেলে থাকা তিন যুবককে চিহ্নিত করেন অনেকে।
স্থানীয়রা জানান, মোটরসাইকেলের মাঝে বসা যুবকের নাম আসিফ। চালক ছিল রায়হান। দুটি ফুটেজে বাইকের পেছনে ভিন্ন দুই যুবককে দেখা গেছে। এতে মনে হচ্ছে কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে আরও কয়েকজন আশেপাশে ছিল।
নিহত মাহবুবের স্ত্রী এরিন সুলতানা বলেন, ‘কুয়েটের ঘটনায় সে (মাহবুব) দলের নির্দেশে গিয়েছিল, নিজের স্বার্থে নয়। মানিকতলায় যুবদলের সুধী সমাবেশের ঘটনায় ওর বন্ধু জাকির মামলা করার পর মাহবুবুরের কাছে নিয়মিত হুমকি আসত; কিন্তু কারা দিচ্ছে, তা বলত না। এখন আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’
মহানগর শ্রমিক দলের সাবেক প্রচার সম্পাদক ও মাহবুবের শ্বশুর আজাদ বেগ বাবু বলেন, ‘কুয়েট ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদলের সংঘাতে যুবদলের নেতা হিসেবে মাহবুব পাশে দাঁড়িয়েছিল। এ ঘটনাও একটি কারণ হতে পারে। ৫ আগস্টের পর দলীয় অফিস ভাঙচুরের ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে মামলা করে মাহবুব। এ ছাড়া মানিকতলায় যুবদলের সুধী সমাবেশে মারামারির ঘটনায় তার বন্ধু জাকির মামলা করলে আসামিরা মাহবুবের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। নিয়মিত তাকে হুমকি দেওয়া হতো।’
আজাদ বেগ আরও বলেন, ‘হত্যাকান্ডে জড়িতরা আওয়ামী লীগের নেতাদের আত্মীয়স্বজন। তারা কুয়েট এলাকায় আরিফকে হত্যা করেছে, চাঁদাবাজিও করছে। কিছুদিন আগে দিলীপ মাস্টারকে গুলি করেছে। খানাবাড়ি এলাকায় হাউস বিল্ডিংয়ের একটি বাড়ির মালিকানা নিয়ে ঝামেলা তৈরি হওয়ায় মাহবুবকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছিল।’
মাহবুবের স্ত্রী এরিনা সুলতানা, শ্বশুর আজাদ বেগ এবং চাচাতো ভাই ও মাহবুবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী আশরাফুলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হুমায়ুন কবীর (হুমা) গ্রুপকে বাগেরহাটে ‘গ্রেফতার করিয়ে দেওয়া’ এবং জেল থেকে অন্য গ্রুপ নেতা আরমানকে জামিনে বের হতে আইনি সহযোগিতার অভিযোগে হুমা গ্রুপের সঙ্গে বিরোধ চলছিল মাহবুবের। তার স্ত্রী এরিনা সুলতানা বলেন, ‘ওরা আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। ওরা বলেছে মাহবুব ওদের নামে মামলা দিয়েছে, ওদের গ্রেফতার করিয়েছে। কিন্তু মাহবুব এসবের কিছুই জানে না, মাহবুব আমাকে নিজের মুখে বলেছে ওদের গ্রেফতারের পেছনে ওর কোনো হাত নেই। তারপরও ওরা শুনল না।’
নিহত মাহবুবের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী তাঁতী দলের থানা পর্যায়ের এক নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি মামলার বাদী হওয়ায় আমাকেই প্রথম টার্গেট করা হয়েছিল। আমাকেও বাড়িতে এসে অস্ত্র ঠেকিয়ে হুমকি দিয়ে গিয়েছে। আমি এখন এদের ভয়ে এলাকার বাইরে যাই না। হুমা গ্রুপ মনে করত, মাহবুব তাদের ধরিয়ে দিয়েছে। মাহবুব বারবার বুঝিয়েছিল, এটা ভুল বোঝাবুঝি। কিন্তু তারপরও কারাগার থেকেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর আতাহার আলী বলেন, সিসিটিভির ফুটেজ দেখে ৩ জন যুবককে শনাক্ত করা হয়েছে। তারা হত্যায় সরাসরি জড়িত কিনা তা শনাক্তের কাজ চলছে। তবে তারা চরমপন্থি দলের সদস্য এটা নিশ্চিত। দ্রুতই তাদেরকে গ্রেফতার করা হবে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার আবু রায়হান মুহাম্মদ সালেহ বলেন, ‘কিছু তথ্য প্রমাণ আমরা প্রাথমিকভাবে পেয়েছি, তদন্তের স্বার্থে সবকিছু বলা যাচ্ছে না। তবে এ হত্যাকান্ডে একাধিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। তিনজন খুনি একটি মোটরসাইকেলে আসে। তাদের একজনের মাথায় হেলমেট ছিল। হত্যাকান্ড সংঘটিত করে তেলিগাতি এলাকা হয়ে বেরিয়ে গেছে তারা। আশপাশের কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে।’