কবির আহমদ, (সিলেট) সাদাপাথর, কোম্পানীগঞ্জ থেকে ফিরে: প্রাকৃতিক মনোরম ভূমি গোয়াইনঘাটের জাফলং এবং কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর পর্যটন এলাকা ঘুরতে প্রতিদিন দেশী বিদেশী হাজারো পর্যটকরা ভিড় জমান। সাদাপাথর না দেখে কোন পর্যটক সিলেট থেকে চলে গেলে তাদের ভ্রমণে যেন পূর্ণতা থেকেই যায়। কিন্তু পাথরখেকোদের কুনজরে পড়ে সাদাপাথর আজ হারিয়ে গেছে। লাগামহীন লুটপাটে প্রায় পাথরহীন হয়ে পড়েছে সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার অন্যতম পর্যটন এলাকা সাদাপাথর। পাথর লোটপাটের ঘটনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সভাপতি সাহাব উদ্দিনের সভাপতি’র পদ স্থগিত করেছে বিএনপি’র হাই কমান্ড। গত রোববার রাতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানানো হয়।

সম্প্রতি পাহাড়ি ঢলের সাথে ধলাই নদের উৎসমুখ সাদাপাথরে বিপুল পরিমাণ পাথর আসে। প্রকাশ্যেই সেই সব পাথর নৌকা করে নিয়ে লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিদিন শত শত নৌকা দিয়ে লুটের পাথর পরিবহন করা হচ্ছে। নদী তীরের বালিও মাটি খুঁড়েও চলছে লুটপাট। ব্যাপক লুটপাটের কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এ এলাকাটি একেবারে বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের সামনেই দিনদুপুরে চলছে এসব লুটপাটের ঘটনা। প্রতিদিন সকাল থেকে সাদা পাথর এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ফাঁড়ি এলাকা মাড়িয়ে জিরো পয়েন্ট দিয়ে পাথর লুটপাট করা হচ্ছে।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে সাদপাথর এলাকায় গিয়ে জানা যায়, গত দুই সপ্তাহে সাদা পাথর এলাকায় কয়েক দফা পাহাড়ি ঢল নামে। প্রতিবারই ঢলের তোড়ে স্তরে স্তরে পাথর ও বালু নামে। এবার দফায় দফায় ঢলের পর শুধু বালু দেখা গেছে। বালুর স্তর সরিয়ে পাথর লুটপাট হয়েছে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, দুই সপ্তাহে অন্তত শতকোটি টাকার পাথর লুটপাট হয়েছে।

সাদা পাথর প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি পর্যটনকেন্দ্র। ২০১৭ সালে পাহাড়ি ঢলে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথরমহালের ধলাই নদের উৎসমুখে পাঁচ একর জায়গাজুড়ে জমা হয় পাথর। ঢলের তোড়ে সেখানে সর্বশেষ ১৯৯০ সালে একবার পাথর জমা হয়েছিল। সেসব পাথরকে ‘ধলাসোনা’ বলে অভিহিত করা হয়। তবে পাহাড়ি ঢলের পর লুটপাটে সেসব পাথর নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ২৭ বছরের মাথায় ফের পাথর জমা হওয়ায় উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পাহারায় সংরক্ষিত হয়। ওই বছর থেকে পুরো এলাকাটি প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়।

সাদা পাথর এলাকার ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল লুংলংপুঞ্জি ও শিলংয়ের চেরাপুঞ্জি। সেখানকার ঝরনা থেকে সারা বছর নদের পানি প্রবহমান থাকে। বৃষ্টিবহুল চেরাপুঞ্জির পাদদেশ থেকে বর্ষায় ঢলের পানির সঙ্গে পাহাড় থেকে পাথরখণ্ড এপারে নেমে আসে। ভেসে আসা এই পাথর উত্তোলিত বা আমদানি করা পাথরের চেয়ে দামি। এটির কদরও বেশি। ব্যবহৃত হয় স্থাপ্যুকাজে।

সাদা পাথর পর্যটন সৃষ্টি ও তদারকি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে মধ্য জুলাই পর্যন্ত মোট ১৩ দফা পাহাড়ি ঢল নেমেছিল। তখন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন প্রাথমিকভাবে হিসাব করেছে ঢলের তোড়ে ওপার থেকে পাথরের অন্তত ১৩টি আস্তরণ পড়ে। পাঁচ একর জায়গার ওপরে অন্তত ২০ ফুট পুরু পাথরের স্তর জমে। তখন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন লুটপাট ঠেকিয়ে পাথরগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ২০১৭ সাল থেকে এটি সাদা পাথর পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিতি পায়। সাদা পাথর এলাকাটির অবস্থান কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নে।

সাদা পাথর যাওয়ার ঘাট হিসেবে পরিচিত ধলাই নদতীরের ভোলাগঞ্জের ১০ নম্বর এলাকা। সেখানকার স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পাহাড়ি ঢল নেমে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পর্যটকরা সাদা পাথরে যাচ্ছেন না। এই সুযোগে চলছে লুটপাট।

সার্বিক পরিস্থিতিতে সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া পুলিশের পক্ষে একা কিছু করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের মাহমুদ আদনান। তিনি বলেন, ‘সাদা পাথর লুটের ঘটনার খবর পেলেই ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে স্পেশাল টাস্কফোর্সের টিম অভিযান চালায়। আমরা পুলিশ দিয়ে সহযোগিতা করছি। এর বাইরে কী আর করার আছে।’

লুটপাট ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী। তিনি বলেন, ‘সাদা পাথর পর্যটন স্পট খুঁড়ে পাথর উত্তোলনের ভিডিওটি আমি দেখেছি। পর্যটন স্পটে এ ধরনের কাজ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটি টিম সেখানে পাঠিয়েছি পরিদর্শনের জন্য। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে আমরা পুলিশ, বিজিবির সমন্বয়ে অভিযান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

সাদাপাথর লুটকারী বিএনপি’র সভাপতির পদ স্থগিত

এদিকে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সাদাপাথর লুটপাটের ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করেছে বিএনপি।

গত রোববার রাতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ন মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পুনের পর থেকেই সিলেটের অন্যান্য পাথর কোয়ারির মতো সাদাপাথরেও শুরু হয় লাগামহীন লুটপাট। এসব লুটপাটে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিএনপি নেতারা সম্পৃক্ত থাকার অবিযোগ রয়েছে।

সাদাপাথরে লুটপাটে প্রথম থেকেই স্থানীয় বিএনপি নেতা সাহাব উদ্দিনের নাম উঠে আসে। তবে এতোদিন বিএনপি তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। গত দুদিন ধরে সাদাপাথরে লুটপাটের বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এনিয়ে শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। এরপর গত রোববার রাতে সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিতের তথ্য জানায় বিএনপি।

রুহুল কবির রিজভী সাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ বিএনপির আদর্শ ও নীতি পরিপন্থী অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের সকল পদ স্থগিত করা হয়েছে। তার স্থলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি হাজী আব্দুল মান্নানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে।