জয়পুরহাট সংবাদদাতা : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়পুরহাট-১ (সদর ও পাঁচবিবি) আসনের প্রার্থী ও ভোটারদের মাঝে নির্বাচনি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিনই জামায়াতপ্রার্থী কর্মী-সমর্থক নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিংসহ গণসংযোগ অব্যাহত। বিএনপির একাধিক প্রার্থী নিজেদের প্রার্থী হিসেবে পরিচিত করতে নির্বাচনি মাঠে নেমেছে। ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ভোটারদের মাঝে ততই নির্বাচনি উচ্ছাস বাড়ছে। পুরনো ঘাটি আর থাকবে না কারও জন্য। পুরানো ম্যাপ আর কাজে আসছেনা। ভোটারদের মাঝেও চলছে নানা ধরনের সমীকরণ।
জয়পুরহাট-১ আসনটি পাঁচবিবি ও জয়পুরহাট সদর উপজেলার ১৯টি ইউনিয়ন, ২টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসের তথ্যানুযায়ী এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৬০ হাজার ৯শ’ ৩৮ জন। এরমধ্যে পুর“ষ ভোটার ২ লাখ ২৯ হাজার ১০ জন নারী ভোটার ২ লাখ ৩১ হাজার ৯ শ’ ২০ জন।
সংসদীয় আসন ৩৪ জয়পুরহাট-১ আসনটি একসময় বিএনপির ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত ছিল। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি দলীয় প্রার্থীরা আওয়ামীলীগের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। অনেকেই মনে করে এই আসনে বিএনপি থেকে দুর্বল প্রার্থী দাঁড়ালেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। কিš‘ সে হিসাব আর ঠিক নেই এখন। তবে ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ভোট বর্জন করলে এ্যাড. সামসুল আলম দুদু আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হোন।
২০২৪ সালে ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশ এখন পুরোপুরি নির্বাচনি আমেজ তৈরি হয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে জয়পুরহাট-১ আসনে দেশের সবচাইতে বড় দল বিএনপির একাধিক প্রার্থীর নাম শোনা গেলেও এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত প্রার্থী মনোনয়ন বা গ্রিনসিগন্যাল দেয়নি দল কাউকে। বর্তমানে দলটিতে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নির্বাচনি প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে। ফলে কে হবেন ধানের শীষের কান্ডারী সেটি এখনো পরিষ্কার নয় নেতাকর্মীদের মাঝে। প্রার্থী চূড়ান্ত করণে জামায়াত এক বছর আগেই একক প্রার্থী হিসেবে জেলা জামায়াতের আমীর ফজলুর রহমান কে স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় ভাবে চূড়ান্ত ঘোষণা করেছেন। এর ফলে অনেক আগেই জামায়াত তাদের একক প্রার্থী নিয়ে পুরো নির্বাচনি এলাকায় মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। ইতি মধ্যেই শহরের বিভিন্ন অলি-গলিতে দাঁড়িপাল্লার বিলবোর্ড-ফেস্টুন দিয়ে প্রাচারণা চালাচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী : জয়পুরহাট-১ আসনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বিপুল সংখ্যক কর্মী সমর্থক রয়েছে। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে একক ভাবে নির্বাচন করে জামায়াতের প্রার্থী মরহুম আব্বাস আলী খাঁন দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে ৪৩ ও ৩৭ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে বিএনপির সাথে জোটভুক্ত নির্বাচন করেন তারা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দলটির উপর নানা দমন নিপীড়ন নির্যাতন চললেও কৌশলে তাদের সাংগাঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে দলকে সকল পর্যায়ে ব্যাপক হারে সুসংগঠিত করেছেন। অপরদিকে ত্রয়োদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি ও অন্যান্য দলের কোন্দলের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রথম বারের মত এবার আসনটি নিজেদের কব্জায় নিতে মরিয়া হয়ে মাঠে কাজ করছেন কর্মী সমর্থকরা। ইতিমধ্যে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা সদস্য ও দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে জয়পুরহাট জেলা জামায়াতের আমীর ডা. ফজলুর রহমান সাঈদকে প্রার্থী হিসাবে ঘোষনা করেছেন। তিনিও নির্বাচনি প্রচার প্রচারণায় অংশ নিয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন। বিভিন্ন মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ওয়ার্ড, পাড়া মহল্লায়, হাট-বাজারে প্রতিদিন ফজর নামাজের পর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিরামহীন ভাবে জনসভা, পথসভা, পেশা ভিত্তিক মতবিনিময় সভা সহ দাঁড়িপাল্লার লিফলেট নিয়ে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছে প্রার্থী সহ দলীয় নেতাকর্মী ও মহিলা কর্মীরা। জনসংযোগের ক্ষেত্রে সব দলের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর এই প্রার্থী। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন ইউনিটের কর্মীরাও আলাদা আলাদা ভাবে নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে দিন-রাত প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিগত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্টের সময় জামায়াতের মিছিলের ১৩জন নেতাকর্মী নিহত ও অসংখ্য আহত হয় এবং মামলা-হামলার শিকার হওয়ায় সাধারণ ভোটারদের সহানুভতী বেড়েছে। এসব দিক বিবেচনা করে সাধারন ভোটারগন বলছেন তাদের একক প্রার্থী থাকায় বেশ সুবিধাজনক এবং শক্ত অবস্থানে রয়েছে জামায়াত। জেলা জামায়াতের আমীর ফজলুর রহমান সাঈদ বলেন, এ আসনে আগামী নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থীকে নির্বাচিত করলে দুর্নীতি মুক্ত, আধুনিক, মানবিক জেলা গড়তে এবং বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা সহ অবহেলিত এ জেলা সার্বিক উন্নয়নে কাজ করা হবে। তিনি বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি জন্য প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা, মাদক মুক্ত সমাজ করতে ক্রিড়া ও ইসলামী সাংস্কৃতি চর্চা সহ জনসচেতনা বৃদ্ধি করা হবে। কৃষি প্রধান জেলা হিসেবে কৃষকদের জন্য কৃষি পন্য সংরক্ষনের জন্য আধুনিকরণ সহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সার্বিক উন্নয়নে অবহেলিত জয়পুরহাট জেলার উন্নয়ন করা হবে।
বিএনপি : বিএনপি থেকে ধানের শীষের মনোনয়ন পেতে যারা দৌড়ঝাঁপ করছেন তাদের একজন, জেলা বিএনপি’র আহবায়ক গোলজার হোসেন বলেন, যারা বিগত আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং কমপক্ষে তাদের বিরুদ্ধে দুই টি মামলা হয়েছিল এমন নেতাকেই মনোনয়ন দিবে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা ছিলনা এবং র্দূদিনে দেশেও অবস্থান করেনি তাদের পাসপোর্ট যাচাই-বাছাই চলছে। এসব বিবেচনায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মনোনয়ন বিষয়ে খুবদ্রুতই সিদ্ধান্ত জানাবেন।
সাবেক মন্ত্রী মরহুম আব্দুল আলীমের জৈষ্ঠ্য পুত্র ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফয়সল আলীম বলেন, আমি মনে করি জয়পুরহাট-পাঁচবিবিতে আমার স্বচ্ছতা, ক্লিন ইমেজ আছে। আমার বাবার উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে দল আমাকে মনোনয়ন দিবে। জয়পুরহাট-পাঁচবিবিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে ক্লিন ইমেজকে বিগত ২০-২৫ বছর ধরে রেখেছি এবং জয়পুরহাট মানুষের সাথে মিশে আছি তাই দল আমাকে অবশ্যই মনোনয়ন দিবে বলে আমি বিশ^াস করি। তিনি আরো বলেন, জয়পুরহাট-পাঁচবিবি’র উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সাথে আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যকে সামনে রেখে আগামী দিনে আমি মনোনয়ন পেলে জয়পুরহাট-পাঁচবিবিকে নতুন ভাবে গড়ে তুলব।
সাবেক এমপি মরহুম মোজাহার আলী প্রধানের দুই সন্তান জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ রানা প্রধান ও পৌর বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আবু রায়হান উজ্জল প্রধান এ দুই ভাই দলীয় মনোনয়ন চান। মাসুদ রানা প্রধান বলেন, বিএনপি’র নেতা-কর্মী, সমর্থক এমনকি সাধারণ ভোটারদের একটাই প্রত্যাশা বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে যে প্রধান পরিবার সর্বোচ্চ মামলা-হামলার শিকার হলেও বিপদে-আপদে মানুষের পাশে ছিলাম। সে জন্য বিএনপি তথা ধানে শীষের বিজীয় হবে। আবু রায়হান উজ্জল প্রধান বলেন, দল যাকেই মনোনয়ন দিবে তার পক্ষ হয়েই কাজ করবো।
বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত জেলা সভাপতি মমতাজ ম-লের সন্তান বিশিষ্ট শিল্পপতি সিআইপি আনোয়ারুল হক আনু যিনি বিভিন্ন সামাজিক মানবিক কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছেন। তিনি চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি এবং একাধিক জাতীয় সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও করোনা মহামারি, বন্যা দুর্যোগের সময় গরীব অসহায়দের বিপুল সংখ্যক মানুষের মাঝে খাদ্য সহায়তা দেওয়ায় তারও বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে সাধারণ ভোটারের মাঝে। “তিনি বলেন, এ জেলার মানুষ একজন নিরাপদ নেতৃত্ব চাই। এ জেলার মানুষ নিরাপদে কর্মস্থলে যাতায়াত করতে চায় বিনা উতকচে গৃহনির্মান করতে চায় এবং ছেলে-মেয়েদের নিরাপদে স্কুল-কলেজে পাঠাতে চায় এবং তাদের সু-শিক্ষিত সন্তানদের বিনা উৎকোচে চাকুরী পেতে চায়, যা আমিই একমাত্র দিতে পারি। তাই দল আমাকে মনোনয়ন দিলে দুর্নীতি দমন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি সহ জেলার উন্নয়নে ভূমিকা রাখবো।”
লন্ডন প্রবাসী এ্যাড. তানজির আল ওহাব, জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য ও পাঁচবিবি উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুল গফুর মন্ডল। তবে কেন্দ্রীয় সংগঠন দলীয় মনোনয়ন যাকেই দিবে তার পক্ষেই কাজ করবেন বলে জানান তারা।
নির্বাচন করার সুযোগ পেলে এ আসনে জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি হেলাল উদ্দিন ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জাপা মনোনীত প্রার্থী ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন দুজনেই দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
এছাড়াও গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য ও জেলা কমিটির সদস্য সচীব মো. আমিনুল ইসলাম মাসুদ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের জেলা শাখার যুগ্ম আহবায়ক মাওলানা আনোয়ার হোসেন প্রার্থী হিসাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রচারণা সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিচিত হচ্ছেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হিসাবে জেলা সভাপতি মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদের নামও শোনা যাচ্ছে। এনসিপি জেলা কমিটি গঠন করলেও দল এখনো সুসংগঠিত হয়নি। সদর উপজেলার বেলআমলা গ্রামের সাবেক সচিব আব্দুল মান্নান প্রার্থী হওয়ার কথা শুনা যাচ্ছে। তবে এখনো চূড়ান্ত হয় নি বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
জয়পুরহাট-১ আসনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে একাধিক সচেতন ভোটার ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে এ আসনের ভোটারদের মধ্যেও চলছে ব্যাপক নির্বাচনি আলোচনা ও ভোটের হিসাব নিকাশ। এই এলাকার ভোটার ও নির্বাচন বিশ্লেষকদের ধারনা জামায়াত ও ইসলামী দলগুলোর মধ্যে জোট হলে জামায়াত এ আসন থেকে নির্বাচিত হবে। কারন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, চারটি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে নির্বাচনে শিবিরের ভুমিধস বিজয়ে জনগনের মধ্যে নতুন করে বিশ^াস আর আস্থা তৈরি হয়েছে জামায়াতের প্রতি। এছাড়াও ব্যাপক জনসমর্থন ও বিশাল ভোটব্যাংকও রয়েছে জামায়াতের। তবে ভোটারদের প্রত্যাশা, দলীয় প্রতীক কিংবা নেতা নয়। প্রয়োজন বাস্তব উন্নয়ন, সমস্যা সমাধানের দিকনির্দেশনা। এমন একজন জনপ্রতিনিধি তারা চান, যিনি দুর্যোগে-দুর্দিনে জনগণের পাশে থাকবেন এমন প্রার্থীকেই নির্বাচিত করবেন।