কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলায় সাংবাদিক দম্পতি মো. কাইসার হামিদ (৫১) ও মোছা. রোকেয়া আক্তার (৪৪) দীর্ঘ ৩১ বছরের দাম্পত্য জীবন পার করে এবছর ২০২৫ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি, সমমান পরীক্ষায় একসঙ্গে অংশ নিয়ে সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) এসএসসি, সমমান ২০২৫ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে জানা যায়, ঢাকা কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এর অধীনে কাইসার হামিদ ও রোকেয়া আক্তার দুজনেই জিপিএ ৪.১১ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

দম্পতির শিক্ষা জীবনের এই নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার বিন্নাবাইদ দারুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা থেকে। ওই মাদ্রাসা থেকে তারা দুজন বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা এর অধীনে কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার লক্ষ্মীপুর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজ কেন্দ্রে দাখিল (এসএসসি সমমান) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এ সফলতা অর্জন করেছেন।

পড়া-লেখার মাঝপথে থেমে যাওয়া এ দম্পতির জীবনে এসএসসি, সমমান পরীক্ষা যেন দ্বিতীয় সূচনা।তাদের এই যাত্রা শুধু তাদের নিজেদের জন্যই নয়, বরং সমাজের অনেক মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখাবে ‘শিখতে কোনো বয়স লাগেনা।’

কাইসার হামিদের বাড়ি কুলিয়ারচর উপজেলার পশ্চিম গোবরিয়া গ্রামে। মুছাম্মৎ রোকেয়া আক্তার জেলার কটিয়াদী উপজেলার দক্ষিণ লোহাজুরী গ্রামের মেয়ে।তারা দুজনে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেন আজ থেকে ৩১ বছর আগে।

মুহাম্মদ কাইসার হামিদ সাহিত্যচর্চা এবং সাংস্কৃতিাঙ্গনেরও একজন সক্রিয় কর্মী। কবিতা লেখেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে তার শতাধিক কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। সাংবাদিকতার কাজেও তিনি জড়িত আছেন।

মুহাম্মদ কাইসার হামিদ গণমাধ্যমকে বলেন, সমাজ থেকে অনেক ভালো কিছু পেয়েছেন। কেবল কষ্ট ছিল পড়া-শোনা নিয়ে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই একই কষ্ট।

পরীক্ষায় পাশ করতে পেরে আনন্দিত রোকেয়া আক্তারের ভাষ্য, ‘অল্প বয়সে বিয়ে হয়। এ কারণে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। এই কষ্ট প্রায় তিন যুগ ধরে বয়ে বেড়াতে হয়েছে। আমরা দুজনই কষ্ট দূর করার উপায় খুঁজতাম।

সাংবাদিক কাইসার হামিদ আরো বলেন “সমাজে ভালো কিছু করতে পেরেছি, কিন্তু একটা জায়গায় মানসিক অস্বস্তি ছিলো—এসএসসি পাস করিনি। অনেক সময় পরিচয় দিতে গিয়ে চুপ থাকতে হতো, কেউ কেউ খোঁচাও দিতেন। তখনই সিদ্ধান্ত নিই—এই অধ্যায় বন্ধ করতে হবে। পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা আর সম্মান ফিরে পেতে যা দরকার, তা-ই করবো। অবশেষে আজ সফল হলাম।”

রোকেয়া আক্তার আরো বলেন, “অল্প বয়সে বিয়ে, সন্তান, সংসার সব মিলিয়ে নিজের পড়াশোনার ইচ্ছেটা চাপা পড়ে ছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে খুব পুড়তাম। সেই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতেই এবার দাখিল পরীক্ষা দিই। পাস করতে পেরে মনে হচ্ছে জীবনের এক বড় ভার নেমে গেছে।”

এই সাংবাদিক দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে নাসরিন সুলতানা স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। দ্বিতীয় মেয়ে জেসমিন স্নাতকের শেষ বর্ষে, তৃতীয় মেয়ে মাইমুনা নার্সিংয়ে পড়ছেন। আর ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুন নবম এবং ফাহিম সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

মেয়ে জেসমিন সুলতানা বলেন, “মা-বাবা এসএসসি পাস নয়, সেটা আমরা কখনও গর্ব করে বলতাম না। কেউ জানতও না। এখন মনে হচ্ছে ওনারা যা করলেন, তা গর্ব করার মতোই। আমাদের ভাইবোনদের জন্য এটা একটা বিশাল অনুপ্রেরণা। এটা প্রমাণ করে লজ্জা নয়, শিক্ষার কোনো বয়স নেই।”

কাইসার হামিদ এবং রোকেয়া আক্তার বর্তমানে দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং দৈনিক বুলেটিনের কুলিয়ারচর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন।