৫২ শতাংশ এলাকা অভয়ারণ্য ঘোষণা
মধু আহরণে জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘের ভয়ের সাথে এবছর নতুন করে যুক্ত ছিল ডাকাতের তৎপরতা। ফলে গত বছরের তুলনায় এবার কমেছে মধু আহরণ। বিপাকে মৌয়ালসহ এ খাতের সাথে জড়িত শ্রমজীবিরা। কাঙ্খিত মধু না পাওয়ায় অনেকেই হয়েছেন ঋনী।
বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে সুন্দরবন থেকে মোট ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু সংগ্রহ করা হয়েছিল। এবার সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৬ কুইন্টালে, যা গতবারের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ কম। গত বছর প্রায় ৮ হাজার মৌয়াল মধু আহরণে নিয়োজিত ছিলেন। এবার নেমে এসেছে প্রায় ৫ হাজারে।
মধু আহরণ কমে যাওয়র পেছনে কারণ হিসেবে মৌয়ালরা বলেন, ডাকাত আতঙ্ক ছাড়াও সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকা অভয়ারণ্য ঘোষণায় মধু আহরণের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে গেছে। তা ছাড়া আগে বন বিভাগ তিন মাস মধু আহরণের অনুমতি দিত। কিন্তু চার বছর ধরে দুই মাস মধু সংগ্রহ করতে দিচ্ছে।
সুন্দরবনের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করেন কয়রা উপজেলার সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, সুন্দরবনে মধু আহরণ কমে যাওয়া উদ্বেগের খবর। কারণ উপকূলীয় এলাকার অনেক মানুষ এ পেশার সাথে জড়িত। সুন্দরবনের মধু জিআই সনদ পেয়েছে। এই সময়ে মধু আহরণ কমে যাওয়া চিন্তার বিষয়। সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের চেষ্টা না করলে শুধু দেশের বাজারই নয়, রপ্তানিও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার মৌয়াল সোহরাব হোসেন বলেন, ভয়ে এবার মধু কাটা বাদ দিয়ে এলাকায় দিনমজুরি করেছেন। বহু বছর ধরে সুন্দরবনে যাই, এবার যেতে না পারায় সংসার চালাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চলতি বছর সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন দাকোপ উপজেলার নিতাই নন্দী। তিনি বলেন, চলতি বছর সুন্দরবনে ডাকাতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ মৌয়াল মধু কাটতে যায়নি। এমনিতেই মধু কম, তার উপর ডাকাত ধরলে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়াতে হয়। মুক্তিপণের টাকা ম্যানেজ করতে অনেক সময় ধার দেনা করতে হয়। সুন্দরবন ডাকাতমুক্ত না হলে আগামী বছর এ পেশা ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন তিনি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনে মধু আহরণের মওসুমের আগে প্রয়োজনীয় বৃষ্টি হলে গাছে গাছে ফুল ফোটে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনাবৃষ্টির কারণে গাছে ফুল ফোটার পরিমাণ কমে যায়। আবার ফুল ফুটলেও দ্রুত তা ঝরে যায়। এ কারণে ফুল থেকে মৌমাছি আগের মতো মধু আহরণ করতে পারে না। এ জন্য সুন্দরবনে মধুর পরিমাণ কমে গেছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে সুন্দরবন থেকে ৪ হাজার ৪৬৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮ কুইন্টালে। ২০২৩ সালে আরও কমে হয় ২ হাজার ৮২৫ কুইন্টাল। ২০২৪ সালে কিছুটা বেড়ে ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল। এবার কমে হয়েছে ২ হাজার ৭৬ কুইন্টাল। যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিল আড়াই হাজার কুইন্টাল।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘সুন্দরবনের পূর্ব অংশে এমনিতেই মধু কম হয়। তার ওপর এবার ডাকাত আতঙ্কে মৌয়ালরা অনেকেই বনে যাননি। এ কারণে মধু সংগ্রহ কমে গেছে।’ সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, মৌয়ালদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। বনাঞ্চলের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি মৌয়ালদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আশা করি আগামী বছর মৌয়ালদের সংখ্যা আরো বাড়বে।