খুলনা ব্যুরো ও মোংলা সংবাদদাতা : দীর্ঘ তিন মাস বন্ধ থাকার পর আবারও খুলে দেওয়া হয়েছে সুন্দরবনের প্রবেশ দ্বার। আজ সোমবার থেকে সুন্দরবনে প্রবেশাধিকার দেওয়া হলো পর্যটক, বাওয়ালি, জেলে ও মৌয়ালদের। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বন্য প্রাণী ও মাছের প্রজনন মওসুম হওয়ায় জুন থেকে আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত সুন্দরবনে পর্যটন থেকে শুরু করে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখে বন বিভাগ। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত কয়েক বছর থেকে ওই কার্যক্রম চলছে। তিন মাস বন্ধ থাকার পর ১ সেপ্টেম্বর সেটি আবার খুলে দেওয়া হয়।

পর্যটকদের স্বাগত জানাতে সুন্দরবনের কটকা, কচিখালী, করমজল, হারবাড়িয়া ও আন্ধারমানিকসহ ১১টি পর্যটনকেন্দ্র সম্পূর্ণ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য সুন্দরবনে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। বনে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য ফরেস্ট স্টেশনগুলোতে অনুমতি পত্রের জন্য ভিড় করছেন মৎস্যজীবীরা। বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, তিন মাস বন্ধ থাকার পর আগামী ১ সেপ্টেম্বর আজ সোমবার থেকে উন্মুক্ত হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। এর ফলে পর্যটক, মৎস্যজীবী ও বনজীবীরা অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারবেন। ইতোমধ্যে আমরা ট্যুর অপারেটর, লঞ্চ ও ট্রলার মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে বৈঠক করে নির্দেশনা দিয়েছি যাতে সুন্দরবনে কোন ধরণের প্লাস্টিক বর্জ্য না ফেলে এবং নিয়ম মেনে যাতে পর্যটকরা সুন্দরবনে ভ্রমণ করেন।

ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আলম ডেভিড বলেন, দীর্ঘ তিন মাস বন্ধ থাকার পর সুন্দরবনের দ্বার খুলে দেওয়ায় ট্যুর সংশ্লিষ্টরা উচ্ছ্বসিত। খুলনা থেকে আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লঞ্চ ও জাহাজ প্রস্তুত আছে। প্রথম দিন ৪-৫টি জাহাজ সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। আমরা আশা করছি প্রতি বছরের মতো এ বছরও সুন্দরবনপ্রেমী পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমণ উপভোগ করতে পারবেন।

জানা যায়, সুন্দরবনে ২৪ ঘণ্টায় রূপ বদলায় ছয়বার। মৌয়াল, জেলে ও বাওয়ালি মিলে ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। জাতিসংঘের ইউনেস্কো কমিশন ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবনের কটকা-কচিখালী, নীলকমল, দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ-মান্দারবাড়িয়া সমুদ্রসৈকত এ তিনটি জোনের ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর এলাকাকে পৃথিবীর ৫৫২তম বিশ্ব ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) হিসেবে ঘোষণা করে। সুন্দরবন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই সুন্দরবন খুব ভোরে এক রূপ। দুপুরে অন্য রূপ। পড়ন্ত বিকেলে আরেক রূপ। সন্ধ্যায় সাজে ভিন্ন রূপে। মধ্য ও গভীর রাতে সৌন্দর্য আরেক রকম। চাঁদনি রাতে এই বনের মোহনীয় রূপ পর্যটকদের মোহিত করে। কচিখালী সমুদ্রসৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার রয়েছে সুযোগ। সুন্দরবনে প্রতি বছর মধু আহরণ মওসুমে অন্তত ১ হাজার মৌয়াল বনে প্রবেশ করেন। এ ছাড়া জেলে ও বাওয়ালি মিলে ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ এ বনের ওপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনের মোট আয়তনের মধ্যে বনের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার ও জল ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার। এ বনে রয়েছে প্রায় ৪৫০টি নদনদী ও খাল। সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, গরান, গোলপাতাসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড রয়েছে। বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল-মায়া হরিণ, লোনা পানির কুমির, অজগর, কচ্ছপ, বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ সরীসৃপ, আট উভচর ও ৩০০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। ২০০৪ সালে ইউএনডিপির প্রাণী জরিপ অনুযায়ী, সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে ৪৪০টি, হরিণ দেড় লাখ, বানর ৫০ হাজার, বন্যশূকর ২৫ হাজার, কুমির ২০০, উদ্বিড়াল ২৫ হাজার। ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৬ প্রজাতির চিংড়ি, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া, ১ প্রজাতির লবস্টার ও ৪২ প্রজাতির মালাস্কা। এ বন থেকে প্রতিবছর মধু আহরণ করা হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার মণ। বর্তমানে ছোটবড় ১২০টি ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনে পর্যটকদের ভ্রমণ কাজে নিয়োজিত আছে। এদের রয়েছে আধুনিক উন্নত সুবিধা সংবলিত জলযান ও নিরাপত্তাব্যবস্থা। এর মধ্যে মানসম্মত ১৫-২০টি হবে। সুন্দরবনের করমজল বন্য ও কুমির প্রজনন কেন্দ্র, হারবাড়িয়া ইকো সেন্টার, কটকা, কচিখালী ও নীলকমল অভয়ারণ্য, শেখেরহাট টেম্বপল, কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম সেন্টার, মান্দারবাড়িয়া অভয়ারণ্য নামের স্পটগুলো পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত।

পর্যটকদের জন্য প্রস্তুত ১১ পর্যটন স্পট: আমাদের মোংলা সংবাদদাতা জানান, তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে আগামী সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) থেকে আবারও পর্যটক ও জেলেদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। নিষিদ্ধ সময় শেষ হওয়ায় অভয়ারণ্য, নদ-নদী ও খালগুলোয় মাছ ধরা, বনজীবীদের নৌযান চলাচল এবং পর্যটকদের ভ্রমণ কার্যক্রম নতুন করে শুরু হবে। বন বিভাগ জানিয়েছে, দর্শনার্থীদের বরণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকার দিকটি মাথায় রেখে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এরই মধ্যে সুন্দরবনের ১১টি পর্যটনকেন্দ্র ও অভয়ারণ্য এলাকা পর্যটকদের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

প্রতিবছরের মতো এবারও ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সুন্দরবনে মাছ ধরা, নৌযান চলাচল ও পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। বন্যপ্রাণী ও জলজসম্পদ সংরক্ষণের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মূলত মাছের প্রজনন মৌসুমে এই উদ্যোগ কার্যকর করা হয়, যাতে নদী ও খালে মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ণ থাকে। ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানিংয়ের (ওজগচ) সুপারিশ অনুযায়ী প্রতিবছর এই তিন মাসের জন্য সুন্দরবন বন্ধ রাখা হয়।

তবে এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার জেলে ও বনজীবীরা। তারা মাছ ধরা, গোলপাতা সংগ্রহ বা অন্যান্য বননির্ভর জীবিকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মোংলার চিলা এলাকার জেলে বিদ্যুৎ মন্ডল ও আব্দুর রশিদ জানান, গত তিন মাস তারা প্রায় অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছেন। সংসার চালাতে অনেককে এনজিও ও মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়েছে। বর্তমানে তারা মাছ ধরার ট্রলার, জাল ও খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত করে সুন্দরবনে ফেরার অপেক্ষায় আছেন।

একইভাবে সংকটে পড়েছেন স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীরাও। ট্যুর অপারেটর জাহিদ মোল্লা ও সোহাগ হাওলাদার বলেন, সেপ্টেম্বরে বনে প্রবেশের অনুমতি মিললেও এটি পর্যটনের অফ সিজন। সাধারণত অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সুন্দরবনে পর্যটকদের ভিড় বেশি থাকে। তারপরও কয়েকজন পর্যটক তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং ট্রলার ও নৌকা প্রস্তুত রাখার কথা বলেছেন। তাদের বিশ্বাস, অক্টোবর-নভেম্বর থেকে পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে শুরু করলে দীর্ঘদিনের ক্ষতি কিছুটা হলেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন ও পর্যটনকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির দৈনিক সংগ্রামকে জানান, কটকা, কচিখালী, করমজল, হারবাড়িয়া ও আন্ধারমানিকসহ ১১টি পর্যটনকেন্দ্র পর্যটকদের স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার সময়ে পর্যটকের পদচারণা না থাকায় বনজ প্রাণীকুল স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠেছে। এখন সকাল-বিকাল হরিণের অবাধ বিচরণ দেখা যাচ্ছে, যা দর্শনার্থীদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ হবে। তিনি আরও জানান, ১ সেপ্টেম্বর থেকে মাছ ধরার অনুমতিপত্র ও পর্যটকদের জন্য প্রবেশপত্র (পাস) ইস্যু শুরু হবে এবং সংশ্লিষ্ট টহল ফাঁড়িগুলোকে সতর্ক অবস্থায় থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বন বিভাগ পর্যটক ও জেলেদের বরণ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। মৎস্যজীবীদের সহায়তার জন্য একটি তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল, যা মৎস্য দফতর যাচাই করছে। আগামী বছর থেকে জেলেরা খাদ্য সহায়তা পাবেন বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। পাশাপাশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব পর্যটনকেন্দ্রে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে প্রতিবছর তিন মাস নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়। এই সময়ে নদী-খালে মাছের প্রজনন বেড়ে যায়, যা সামগ্রিকভাবে মাছের মজুদ বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে। এই উদ্যোগ কেবল প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণেই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দরবনের পরিবেশ টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

দীর্ঘ তিন মাস অপেক্ষার পর অবশেষে সুন্দরবন আবারও জেলে, বনজীবী ও পর্যটকদের জন্য দ্বার খুলতে যাচ্ছে। স্থানীয় মানুষের জীবিকার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে, পাশাপাশি পর্যটন খাতে গতি ফিরবে। বন বিভাগ আশা করছে, নিরাপত্তা ও পরিবেশ সংরক্ষণের সমন্বয়ে সুন্দরবন আগামীতেও দেশের জন্য এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে টিকে থাকবে।