রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরের শিয়ালবাড়িতে লাগা আগুনে যে ১৬ টি তাজা প্রাণ অকালে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে, তার একটিরও চেহারা চেনার উপায় নেই। এমনটাই বিকৃত হয়েছে যে, ওই সব চেহারা শনাক্তে লাগবে ডিএনএ টেস্ট। এরমধ্যেই ১৬ টি প্রাণের খোঁজে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে এসেছেন ১৭ পরিবার। তাদের মধ্যে ১০ টি পরিবারই তাদের ১০ স্বজনের লাশ শনাক্তের দাবি করেছেন কর্তৃপক্ষের কাছে। মর্গের সামনে এসব স্বজনদের গগনবিদারী আহাজারিতে জানা গেল, আগুনে শুধু তাদের স্বজনদের দেহই পোড়েনি, পুড়েছে যাবতীয় স্বপ্নও। এখন তাদের সামনে কেবল অথৈ পাথার।

এদিকে, টানা প্রচেষ্টার পর ফায়ার সার্ভিসের দলবদ্ধ কর্মীরা ২৭ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে। পুরোপুরি নেভাতে লাগবে আরও কয়েক ঘণ্টা। এরপরই সেখানে চালানো হবে তল্লাশী কার্যক্রম।

শিয়ালবাড়ির একটি টিনশেড দোতলা রাসায়নিক গুদামে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আগুন লাগে। গুদামে আগুন ধরে বিস্ফোরিত হয়ে পাশের চারতলা ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। পরে চারতলা ভবনের দোতলা ও তিনতলার বিভিন্ন স্থান থেকে ১৬টি লাশ উদ্ধার করা হয়। ভবনটির দোতলায় স্মার্ট প্রিন্টিং নামের একটি কারখানায় টি-শার্ট প্রিন্ট করা হয়। আর তিন ও চারতলায় আরএন ফ্যাশন নামের একটি পোশাক কারখানা আছে। ভবনটি চারতলা হলেও ছাদে টিনশেড দিয়ে আরও একটি তলা করা হয়েছে। এই ভবন ও টিনশেডের রাসায়নিক গুদামে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ভবন ও গুদাম কোনোটিরই ফায়ার সেফটি প্ল্যান বা লাইসেন্স ছিল না।

ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, যে ১৬ জনের লাশ মিলেছে, তাদের সবার চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের পরেই লাশগুলো হস্তান্তর করা হবে।

রাসায়নিক গুদামটি অবৈধ তিনবার নোটিশও দেওয়া হয়েছিল : ফায়ার সার্ভিস

ফায়ার সার্ভিসের তৈরি করা অবৈধ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় শিয়ালবাড়িতে আগুনে পুড়ে যাওয়া রাসায়নিক গুদাম আলম ট্রেডার্সও ছিল বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ডে মেইটেন্যান্স) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম। গতকাল বুধবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান তিনি। তাজুল ইসলাম আরও জানান, সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে বিষয়টি জানানোর পাশাপাশি তিনবার ওই গুদামে নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। এখন ওই গুদাম অভিযান চালানোর পর্যায়ে ছিল। রাসায়নিকের তেজস্ক্রিয়তার কারণে গুদামে এখনো সার্চ অপারেশন চালানো যায়নি বলেও জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আরও ৩৬ থেকে ৭২ ঘণ্টা লাগতে পারে। এখন রাসায়নিক দ্রব্যগুলো পানি ছিটিয়ে অপসারণ করা হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ডে মেইটেন্যান্স) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা গতকাল ১১টা ৪০ মিনিট থেকে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেছি। এই পর্যন্ত অগ্রগতি হচ্ছে গতকালকেই গার্মেন্টস অংশের আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। পাশে যে কেমিক্যালের গোডাউন, যেটা আলম ট্রেডারস নামে পরিচিত, সেই গোডাউনের আগুন আমরা আজ বেলা ২টা ২০ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে আনার ঘোষণা করেছি।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, তবে এখানে বেশ কিছু বিষয় রয়েছে। এটা একটা রাসায়নিক গুদাম এবং এখানে ছয়-সাত ধরনের বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য রয়েছে। তবে কী ধরনের রাসায়নিক বা এগুলোর মাত্রা কী, তা এখনো যাচাই-বাছাই করা যায়নি। পুরো গুদাম বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যে ভরা। পানি ছিটিয়ে এসব রাসায়নিক পরিষ্কার করা হচ্ছে। কাজটি সময় সাপেক্ষ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সিস্টেমেটিক কাজ করছি। টেকনোলজি অ্যাপ্লাই করছি। ড্রোন দিয়ে দেখছি এবং আমরা বোঝার চেষ্টা করছি।

আলম ট্রেডার্সের ভবনটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, গুদাম অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লম্বা সময় ধরে উচ্চ তাপমাত্রার কারণে এই ভবনের পিলারগুলো অনেকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে রাজউক, ভবন বিশারদ, যাঁরা দায়িত্বশীল ব্যক্তি রয়েছেন, তারাই বলতে পারবেন যে কতটুকু ক্ষতি হয়েছে। এখানে যেকোনো অভিযান চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকি এড়াতে নিরাপত্তার সঙ্গে ধাপে ধাপে কাজ করা হচ্ছে।

ভেতরের অবস্থার বিষয়ে তাজুল ইসলাম জানান, আলম ট্রেডার্সের মূল দরজায় তালা মারা ছিল। হাইড্রলিক স্প্রেডার ও কাটার দিয়ে এটাকে কেটে তারপর খুলতে হয়েছে। সুতরাং ধারণা করা হচ্ছে যে এখানে হয়তো মানুষ ছিল না। তারপরও সার্চ অপারেশন না চালানো পর্যন্ত বলা যাবে না, এখানে মানুষ ছিলেন কি ছিলেন না।

১০ জনের লাশ শনাক্তের দাবি স্বজনদের

আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ১৬ জনের মধ্যে ১০ জনের মরদেহ শনাক্তের দাবি করেছেন স্বজনেরা। এ তথ্য জানিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, সব কটি লাশের চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। তবে ১০ জনের লাশ শনাক্তের দাবি করেছেন স্বজনেরা। ভবিষ্যতে সমস্যা এড়াতে এখন সব কটি লাশের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হবে। পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে স্বজনদের কাছে আপাতত এই ১০টি লাশ হস্তান্তর করা যাবে।

উদ্ধার হওয়া ১৬টি লাশ গতকাল সন্ধ্যার পর ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়। হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান গতকাল দুপুরের দিকে তার দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, ৯ জন পুরুষ ও ৭ জন নারীর লাশ এখানে এসেছে। লাশগুলো হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা হয়েছে। স্বজনেরা চাইলে, আর পুলিশ বা জেলা প্রশাসন অনুমতি দিলে শনাক্ত হওয়া লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়া হস্তান্তর করা যাবে।

ঢামেকে ১৬ লাশ, এলেন ১৭ পরিবার

অগ্নিকা-ে ১৬ জন নিহতের খবর পাওয়া গেলেও লাশ খুঁজতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে এসেছেন ১৭টি পরিবার। গতকাল বিকেলে ঢামেক মর্গে নিহত স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা যায়। নিহত দাবিকৃত ১৭ জন হলেন- মো. আল মামুন (৩৯), মো. নূরে আলম সরকার (২৩), ফারজানা আক্তার (১৫), নার্গিস আক্তার (১৮), খালিদ হাসান সাব্বির (২৯), আব্দুল আলিম (১৪), রবিউল ইসলাম রবিন (২০), মাহিয়া আক্তার (১৪), জয় মিয়া (২০), মাজিয়া সুলতানা (১৮), আসমা আক্তার (১৩), সানোয়ার হোসেন (২২), মুনা আক্তার (১৬), মৌসুমী খাতুন (২২), মুক্তা (৩৬), তোফায়েল আহমেদ (১৮) ও নাজমুল ইসলাম রিয়াজ (৩৮)।

রূপনগর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোখলেছুর রহমান লস্কর বলেন, অগ্নিকা-ের ঘটনায় আমরা এখন পর্যন্ত ১৬টি লাশ বুঝে পেয়েছি। ১৬টি লাশের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৬টি লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে এবং ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। লাশগুলোর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে, এরপর পরিবারের নমুনার সঙ্গে মিলিয়ে হস্তান্তর করা হবে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত লাশের খোঁজে ১৭ পরিবার আমাদের কাছে এসেছিলেন। সব ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ ও মিলিয়ে পরিবারের সঙ্গে যাচাই শেষে লাশ হস্তান্তর করা হবে।

২৭ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে

মিরপুরের রূপনগরে কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন প্রায় ২৭ ঘণ্টা চেষ্টা করে নিয়ন্ত্রণে এনেছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট সর্বশেষ কাজ করে ঘটনাস্থলে। ভয়াবহ এই আগুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জন্য নিহত হয়েছে। গতকাল বিকেলে ৪টা ২০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম। তিনি বলেন, বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সর্বশেষ আমাদের ৫টি ইউনিট কাজ করছিল।

পুড়ে শেষ তোফায়েলের বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন, নূপুর দেখে চেনা গেল দগ্ধ নার্গিসকে

বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তরুণ তোফায়েল আহমদ। বয়স তার ২১ বছর। একটি জনশক্তি রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানে টাকাও জমা দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার হয়েছিল। অপেক্ষায় ছিলেন কাগজপত্র পাওয়ার। এই অপেক্ষার সময়টুকু বেকার বসে না থেকে যোগ দিয়েছিলেন মিরপুরের এক পোশাক কারখানায়। কিন্তু অপেক্ষার কাল তার আর শেষ হলো না। মঙ্গলবার মিরপুরের শিয়ালবাড়ির পোশাক কারখানায় অগ্নিকা-ে নিহত হয়েছেন তোফায়েল আহমদ। গতকাল বুধবার দুপুর সাড়ে বারোটায় মুঠোফোনে তোফায়েল আহমদের পুড়ে যাওয়া লাশের ছবি নিয়ে মর্গের সামনে অপেক্ষা করছিলেন তার চাচাতো ভাই শরাফাত হোসেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে মিরপুর শিয়ালবাড়ি অগ্নিকা-ে নিহত ১৬ জনের লাশ রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতেই লাশগুলো এখানে আনা হয়। আগুনে পুড়ে সেগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। রাত থেকেই নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনেরা এখানে আসেন। মধ্যরাত পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করেন। কেউ কেউ লাশের পোশাক-আশাক বা কোনো বিশেষ নিদর্শন দেখে শনাক্ত করেন। তবে রাতে লাশ হস্তান্তর করা হয়নি। গতকাল সকাল থেকে আবার স্বজনেরা মর্গের সামনে ফিরে আসেন লাশ পাওয়ার জন্য। তাদের বিলাপে পরিবেশ বেদনাবিধুর হয়ে ওঠে।

তোফায়েল আহমদের চাচাতো ভাই শরাফত হোসেন জানালেন, তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। তোফায়েল আহমদেরা দুই ভাই-বোন। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। তার বাবা জজ মিয়া কৃষক। তোফায়েল এসএসসি পাস করে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কয়েক মাস আগে তিনি ঢাকায় এসে রূপনগরের একটি মেসে থাকতেন। অপেক্ষার সময়টুকু পোশাক কারখানায় যোগ দিয়েছিলেন। আগুনে পুড়ে শেষ হলো তার বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন। রাতেই তারা মর্গে তোফায়েলের লাশের পোশাক দেখে শনাক্ত করেছেন। বাড়িতে খবর পাঠানো হয়েছে। এখানে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কাজ চলছে। লাশ তিনিই বাড়িতে নিয়ে যাবেন বলে জানালেন শরাফত।

নার্গিস আক্তার (১৯) মাত্র দুই সপ্তাহ হলো পোশাক কারখানায় কাজে যোগ দিয়েছিলেন। তার পায়ের নূপুর ও মাথার খোঁপা দেখে তাকে শনাক্ত করেছেন ছোট বোন মৌসুমি আক্তার। মর্গের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে মৌসুমি জানান, গত বছর নার্গিস আক্তার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্কুল ও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। তার বাবা ওয়াজিউল্লাহ ফলের আড়তে কাজ করেন। তারা চার বোন। নার্গিস ছিলেন দ্বিতীয়। বাবার একার আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। সে কারণে নার্গিস পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেছিলেন। তার কোনো মুঠোফোন নেই। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পরে ওই কারখানার লাইনম্যানের কাছ থেকে ফোন পেয়ে তারা ঘটনাস্থলে যান। রাতেই বাবার সঙ্গে ঢাকা মেডিকেলে এসে নূপুর দেখে বোনের লাশ শনাক্ত করেন। রাতে তাদের জানানো হয়, পরদিন (বুধবার) লাশ দেওয়া হবে। রাত একটার দিকে তারা ফিরে যান। তার মা অসুস্থ, মেয়ের মৃত্যুতে আরও ভেঙে পড়েছেন। বাবা পুলিশ রিপোর্ট আনতে গেছেন। আর মর্গের সামনে বসে বসে বোনের শোকে কাঁদছিলেন মৌসুমি।

মাহিরার আয়েই চলত সংসার

রূপনগরের ৯ নম্বর সড়কে মাহিরা আক্তার (১৪) ও সানজিদা আক্তারকে (১৫) নিয়ে থাকেন মা ফাতেমা বেগম। গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদরে। স্বামী ফারুক হোসেন প্রয়াত। তিনি নিজেও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। কাজের সামর্থ্য নেই। দুই মেয়ে পোশাক কারখানায় কাজ করে। তাদের আয়েই চলে সংসার। ছোট মেয়ে মাহিরা কাজ করত শিয়ালবাড়ির অগ্নিকা- কবলিত কারখানার তৃতীয় তলায়। মেয়েকে হারিয়ে মর্গের সামনে বিলাপ করছিলেন ফাতেমা বেগম। কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। আত্মীয়রা তাকে সান্ত¡না দিচ্ছিলেন। পাশে বসা বড় বোন সানজিদা আক্তার জানাল, সে অন্য একটি কারখানায় কাজ করে। অগ্নিকা-ের খবর পেয়ে মামা শফিকুল ইসলামকে নিয়ে রাতেই তারা ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এসে পোশাক দেখে বোনের লাশ শনাক্ত করেছে।

স্বামীর খোঁজে দুই ছেলেকে নিয়ে মর্গে

অগ্নিকা-ের পর থেকে নজরুল ইসলামের (৪০) কোনো খোঁজ পাচ্ছে না তার পরিবার। গতকাল সকালে মর্গের সামনে স্ত্রী নার্গিস ইসলাম দুই ছেলে মিরাজুল ইসলাম (২০) ও ইয়াসিন আরাফাতকে (১৬) নিয়ে মর্গের সমনে অপেক্ষা করছিলেন। মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে থাকেন বলে জানান তারা। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া। নজরুল ইসলাম ওই ভবনের তৃতীয় তলায় পোশাক কারখানার কাজ করতেন। অগ্নিকা-ের পর থেকেই তার মুঠোফোনটি বন্ধ রয়েছে। মর্গে ১৬ জনের লাশ আছে। তারা লাশ দেখার সুযোগ পাননি। রাতে যাঁরা মর্গে এসেছিলেন, তাদের কেউ কেউ লাশ শনাক্ত করতে পেরেছেন। অপেক্ষা করছিলেন পুলিশের অনুমতি নিয়ে লাশ দেখার জন্য।

অনেকের স্বজন এখনো নিখোঁজ

অগ্নিকা-ের পর গতকাল দুপুর পর্যন্ত অনেকের স্বজন নিখোঁজ রয়েছেন। স্বজনের সন্ধানে ছবি নিয়ে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন রিকশাচালক আবদুল মান্নান। তার মেয়ে মৌসুমি আক্তার (২০) অগ্নিকা-ের পর থেকেই নিখোঁজ। রূপনগর আবাসিক এলাকার ২৬ নম্বর সড়কে তিনি থাকেন। তার তিন মেয়ের মধ্যে মৌসুমি দ্বিতীয়। আগে মৌসুমি অন্য একটি করখানায় কাজ করতেন, এই মাসের শুরুতে এখানে যোগ দিয়েছেন। মৌসুমি আক্তারের কাছে মুঠোফোন ছিল, কিন্তু সেটি এখন বন্ধ।

মুক্তা বেগমের (২০) খোঁজে মর্গে এসেছিলেন তার মামা আবুল দেওয়ান। তিনি জানালেন, মুক্তা শিয়ালবাড়ির ২ নম্বর সড়কে তার খালা রিনা বেগমের সঙ্গে থাকতেন। তাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়ায়। মা-বাবা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। অগ্নিকা-ের পর থেকে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

মোজাম্মেল হোসেন এসেছিলেন ভাতিজা খালিদ হোসেনের (২৯) খোঁজে। তার গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদরে। ঢাকায় মোহাম্মদপুর এলাকায় মেসে থাকেন খালিদ। সম্প্রতি তিনি বিয়ে করেছেন। অগ্নিকা- কবলিত পোশাক কারখানার চতুর্থ তলায় তিনি কাজ করতেন। অগ্নিকা-ের পর থেকে ফোন বন্ধ। রাতে কারখানার সামনে গিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করে সন্ধান পাননি। সকালে এসেছেন মর্গে। এখানে লাশ পাওয়া যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আছেন তিনি।

আগুন এখনো নেভেনি

রাসায়নিকের গুদামে লাগা আগুন নেভাতে ‘কয়েকদিন লাগতে পারে’ বলে মঙ্গলবার রাতে বলেছিলেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল। গতকাল বুধবার দুপুর পর্যন্ত আগুন না নেভার তথ্য দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। গুদাম থেকে এখনো বিষাক্ত ধোঁয়া বের হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অক্সিজেন ট্যাংক নিয়ে, গ্যাস মাস্ক পড়ে সেখানে কাজ করছেন। এদিন দুপুরে অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে বুয়েটের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

জনবহুল এলাকায় রাসায়নিক গুদাম থাকতে পারে না: উপদেষ্টা শারমীন মুরশিদ

অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেছেন, জনবহুল এলাকায় রাসায়নিকের গুদাম চলতে পারে না। বেআইনিভাবে করা এসব রাসায়নিক মজুত রাখার ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। গতকাল বুধবার দুপুরে মিরপুরে রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকা-ের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে উপদেষ্টা এ কথা বলেন।

তদন্ত কমিটি গঠন, আর্থিক সহায়তার ঘোষণা

রূপনগরে শাহ আলম কেমিক্যাল গোডাউন ও পাশের একটি গার্মেন্টস কারখানায় আগুনের ঘটনায় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব লস্কার তাজুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে গঠিত সাত সদস্যের এ কমিটি আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবে। এছাড়া নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়েছে, নিহত শ্রমিকের প্রত্যেক পরিবারকে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে ২ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে এবং আহত শ্রমিকদের চিকিৎসায় ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হবে।

এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন তিনি।

অগ্নিকা-ের কারণ, দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে সুপারিশ ওই তদন্ত কমিটি। এছাড়া কমিটি আহত ও নিহতদের তালিকা প্রণয়ন, পরিদর্শন প্রক্রিয়ায় কোনও গাফিলতি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা, কারখানার ঝুঁকি নিরূপণ, ঝুঁকি নিরসনের সুপারিশ এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ বিষয়ে সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে দাখিল করবে।