এফ, এ আলমগীর, চুয়াডাঙ্গা সংবাদদাতা: দেশের একমাত্র দোতলা স্টেশন আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনটি নানা সমস্যায় জর্জরিত। ঐতিহ্যবাহী রেলস্টেশনের মূলভবন সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই। ব্রিটিশ আমলের অনুপম স্থাপত্যের স্মারকের শরীরজুড়ে এখন পরগাছাদের বসবাস। দেশের একমাত্র দ্বিতল স্টেশনের অনন্য গৌরব একমাত্র আলমডাঙ্গা বহন করছে। ব্রিটিশ শাসনামলে রেল বিভাগের আভিজাত্য আর অপরিমেয় শান-শওকতের এক দৃষ্টিনন্দন স্মারক এ স্টেশন। ভারতবর্ষে প্রথম রেল চালুর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এ রেলস্টেশন ভবনের গোড়াপত্তন বলে ধারণা করা হয়। তৎকালে বিলের মধ্যদিয়ে এ রেললাইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে রেললাইন অনেক উঁচুতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সে কারণেই বাস্তব প্রয়োজনীয়তা থেকেই এখানে দোতলা স্টেশন ভবন নির্মাণ করা হয়। মোঘল আর ইংরেজ আমলের বিশেষ স্থাপত্য শৈলীর এক অনুপম দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এ দ্বিতল স্টেশনটি। এখানে শুধু দোতলা স্টেশন ভবনই নির্মাণই করা হয়নি, এ দোতলা রেলস্টেশনের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ইউরোপ থেকে সৌন্দর্যবর্ধক বহু বিরল প্রজাতির গাছ এনে লাগানো হয়েছিল। নানা প্রজাতির ফুলের গাছ রোপণ করা হয়েছিল। সেগুলোর অবশিষ্ট অংশ হিসেবে এখনও স্টেশনের প্লাটফর্মে ২টি বিরল প্রজাতির পামট্রি রয়েছে। রয়েছে অযত্ন আর বয়ঃভারাক্রান্ত ২ কাঠমল্লিক ফুলগাছ। এ গাছগুলোর বয়স শতাধিক বছর। আলমডাঙ্গা জনপদের গোড়াপত্তনের সমসাময়িক বয়স এদের। উপমহাদেশে রেলের ইতিহাসে আভিজাত্যপূর্ণ ঐতিহ্যের স্মারক আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনটি এখন নানা সমস্যার আবর্তে। দৃষ্টিনন্দন ও আভিজাত্যপূর্ণ নির্মাণশৈলীর এ দ্বিতল স্টেশন ভবনটির আদি স্থাপত্যশৈলী অক্ষুণ্ন রেখে দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। বেশ কয়েক বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী এই রেলস্টেশন ভবনটির কোন সংস্কার করা হয়নি। এমনকি দেয়ালে পড়েনি রঙের পরশ। দীর্ঘদিনের অবহেলায় এই ইংরেজ আমলের ঐতিহ্যের স্মারকের অবয়বজুড়ে জন্মেছে জঙ্গল। সামনের দেয়ালে যেখানে সেখানে দীর্ঘদিনের বসবাস বট-পাইকড়ের বনসাই। এদের উপরাংশে বাড় বাড়ন্ত কম হলেও নিচে শেকড়ের রাজত্ব মোঘল সাম্রাজ্যকে হার মানায়। দেখে মনে হয় এ ঐতিহ্যের স্মারক দেখভালের কেউ নেই।
আলমডাঙ্গাবাসী রেললাইনের সংস্কার, স্টেশনের সংস্কার, ঢাকাগামী ট্রেনের বরাদ্ধকৃত সিট সংখ্যা বৃদ্ধি ও নতুন ট্রেনের দাবিতে বেশ সোচ্চার। এলাকাবাসীর উল্লেখযোগ্য দাবির মধ্যে রয়েছে দেশের একমাত্র দ্বিতল রেলওয়ে স্টেশন ভবনের আদি নির্মাণশৈলী অক্ষুণ্ন রেখে আধুনিকায়ন, আপ ও ডাউন প্লাটফর্ম বর্ধিতকরণ, এক্সপ্রেস রোড, ফুটওভার ব্রিজ স্থাপন, যাত্রী ছাউনি বর্ধিতকরণ ও চিত্রা-সুন্দরবন এক্সপ্রেসের বরাদ্ধকৃত আসনসংখ্যা বাস্তবতার নিরিখে বৃদ্ধি। এ ছাড়াও আলমডাঙ্গা অঞ্চলে রেললাইনে ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে।
ইতিহাসে আলমডাঙ্গা: ১৮৩২ সালে প্রথম ভারতে রেল ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১৮৫১ সালের ২২ ডিসেম্বর ভারতে প্রথম রেল চালু হয়। ভারতে স্থানীয় একটি খাল নির্মাণকার্যে মালপত্র আনা-নেয়া করার জন্য এই ট্রেনটি চালু করা হয়েছিল। তবে এটাকে অনেকেই রেলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা হিসেবে স্বীকার করেন না। তাদের দাবি এটি ছিলো রেল লাইন প্রতিষ্ঠার একটি প্রক্রিয়া। ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল গেট ইন্ডিয়ার পেনিনসুলার রেলওয়ে নামক কো¤পানি কর্তৃক নির্মিত মুম্বাই থেকে আনা পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘরেল লাইনটির উদ্বোধন করা হয়। এটিই ছিলো ব্রিটিশ ভারতের রেলওয়ের প্রথম যাত্রা। ১৮৫৪ সালে ভারতের তৎকালীন গবর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসির নির্দেশে মূলত বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬২ সালে। বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে। সে সময় চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়া জেলার জগতি পর্যন্ত ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার লাইন স্থাপিত হয়। নীলকরদের বিরুদ্ধে এতদাঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহের কারণে বিতাড়িত কিছু নীলকর জগতিতে আখ মাড়াইয়ের কল উৎপাদন শুরু করেছিল। ভারী ভারী আখমাড়াইয়ের কল বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের নিকট পৌঁছানো সহজ হবে রেলপথে। এমন চিন্তা থেকেই কুষ্টিয়ার জগতিতে পর্যবসিত প্রাক্তন নীলকরদের স্বার্থে ও প্রযত্নে অবহেলিত এ জনপদে অন্যান্য অঞ্চলের অগেই রেলের যাত্রা শুরু। পরে ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি গোয়ালন্দ পর্যন্ত সেকশনটি চালু হয়। অবশ্য বাংলায় আরও প্রায় ৮ বছর পূর্বে প্রথম রেলপথ চালু হয় ১৮৫৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার রেলপথের উদ্বোধনের মাধ্যমে। ১৮৯৭ সালে দর্শনা-পোড়াদহ সেকশনটি সিঙ্গেল লাইন থেকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়। পর্যায়ক্রমে ১৯০৯ সালে পোড়াদহ-ভেড়ামারা, ১৯১৫ সালে ভেড়ামারা-ঈশ্বরদী এবং ১৯৩২ সালে ঈশ্বরদী-আব্দুলপুর সেকশনগুলোকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়। আলমডাঙ্গায় কুমার নদের ওপর লাল ব্রিজ খ্যাত বর্তমান রেলওয়ে ব্রিজটি ১৯০৯ সালে উদ্বোধন করা হয়। তারপর কালিদাসপুর থেকে রেলস্টেশন আলমডাঙ্গায় স্থানান্তরিত হয় বলে জানা যায়।